দৈনিক দিশারী ডেস্ক
——————
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে মৌসুমি নিম্নচাপ বেড়েছে দেশের উপকূলে। এতে উপকূলের সাত হাজার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা ১৩৯টি পোল্ডারের বেশিরভাগই নড়বড়ে হয়ে পড়ছে। পোল্ডার বলতে মূলত বন্যা নিরোধের জন্য দীর্ঘ বাঁধ দিয়ে বেষ্টিত এলাকাকে বোঝানো হয়।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ। আর এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বিডব্লিউডিবি) অর্থায়নে সম্প্রতি একটি গবেষণা চালায় বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট (আইডব্লিউএফএম)। গবেষণা প্রকল্পটির শিরোনাম ছিল এন ইনভেস্টিগেশন অন দ্য কজেস অব এমব্যাঙ্কমেন্ট ফেইলিওর অ্যান্ড রেকমেন্ডেশন্স ফর সাসটেইনেবল সলিউশন্স (সিইএফ)।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রের উচ্চতা ২১০০ সালে দশমিক ৫ থেকে সর্বোচ্চ এক মিটার পর্যন্ত বাড়বে। ২৩০০ সালে দুই মিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি। তবে ইতোমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব দেখা দিয়েছে। রাজবাড়ী অংশে পদ্মা ১৬ দশমিক পাঁচ কিলোমিটারের বেশি ভাটির দিকে সরে এসেছে। ভবিষ্যতে আরও সরবে। এতে দুই ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। সরে আসার কারণে নদীর পাড় আরও ভাঙবে।
দ্বিতীয়ত, নদীতে চর জেগে উঠবে এবং স্রোত ও পানির প্রবাহ তীব্র হবে। ফলে ভাঙন আরও বাড়বে। ২০২০ সালের বন্যায় তিস্তার ভাঙনের কারণে হুমকির মুখে পড়ে স্থানীয়দের নির্মিত দুই হাজার মিটার বাঁধ। এতে ঝুঁকিতে পড়ে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় ঘরবাড়ি এবং ফসলি জমি হারাবে হাজার হাজার মানুষ।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্মিত বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করা ছিল প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য। এজন্য আটটি অঞ্চলের বাঁধগুলোর বিদ্যমান নকশা, এক-দুই-ত্রি-মাত্রিক হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল মডেলিং, উপকূলীয় এবং মোহনা মডেলিং, ভূ-প্রযুক্তিগত তদন্ত এবং ত্রুটির কারণ পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করে বুয়েট।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বেশিরভাগ বাঁধ নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে টেকসই ও প্রযুক্তিগত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বাঁধগুলোর বেশিরভাগেরই এক কিলোমিটারের মধ্যে জলাশয় থাকা এবং নদীর মাঝ অংশ থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়টি উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। উপকূলীয় অঞ্চল ও দেশের অন্য নদীগুলোর তীরে সবুজ বেষ্টনী না থাকায় বেড়েছে নদী ভাঙন, যা আগামীতে আরও বাড়বে।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত করে বেশকিছু ঘূর্ণিঝড়। এর মধ্যে ২০২২ সালে অশনি, সিত্রাং, ২০২১ সালে ইয়াস, ২০২০ সালে আম্ফান, ২০১৯ সালে ফণী ও বুলবুল, ২০১৭ সালের মোরা এবং ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু অন্যতম। তবে ঘূর্ণিঝড়গুলো ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের সাইক্লোন আইলার মতো তীব্র ছিল না। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার পোল্ডারগুলোকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলো। তাই নদী ভাঙন রোধে প্রকৃতি ও ভূগঠনকে প্রাধান্য দেওয়া, প্রকৃতিবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার, বাঁধ ও পোল্ডার নির্মাণ টেকসই করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন গবেষকরা।
গত তিন বছর সরেজমিন গবেষণা ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি সম্পন্ন করে বুয়েট। এই গবেষণা বলছে, ২০৫০ সালে ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ ১৮.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এতে তীব্র হবে বন্যার ঝুঁকি। এক ও দুই মাত্রিক মডেলিং থেকে ত্রি-মাত্রিক মডেলিংয়ে ক্ষতির বিষয়গুলো বেশি বলে জানিয়েছেন গবেষণা প্রকল্পটির প্রধান ড. সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, নির্মাণে ত্রুটি, অব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টেকসই হচ্ছে না নদনদীর বাঁধ ও পোল্ডারগুলো। এতে আগামীতে বড় ধরনের জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ।
বরগুনার বেতাগী ইউনিয়নে প্রায়ই মৌসুমি নিম্নচাপের ঘটনা ঘটছে। ২০২০ সালে গবেষণা চলাকালে সেখানকার পোল্ডারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। আর প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় মৌসুমে ঘন ঘন সৃষ্টি হচ্ছে শক্তিশালী মৌসুমি নিম্নচাপ। এতে বাতাসের গতিবেগে তারতম্যের কারণে এবং তা হারিকেনের সঙ্গে সমাপতিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বেড়িবাঁধ ও পোল্ডারগুলোকে। এ ছাড়া দেশের ১৬ হাজার কিলোমিটার নদী এলাকায় থাকা বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই এখন নড়বড়ে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি বছর এখন দুটি সাইক্লোন হচ্ছে। আবার মৌসুমি নিম্নচাপও বেড়েছে। মৌসুমি নিম্নচাপ বাঁধের ক্ষতি করছে। যদি অমাবশ্যা বা পূর্ণিমায় নিম্নচাপ হয় তাহলে এটি সাইক্লোনের চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে পোল্ডারগুলোর। এর প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্বজুড়ে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যার ফলে পানির উচ্চতা ও এনার্জিও বেড়ে যায়।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ ব্রহ্মপুত্র নদে পানির প্রবাহ ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এখনও সুন্দরবনের একাংশকে পোল্ডার দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়নি। ফলে এই বনের বড় একটি অংশ পানির নিচে ডুবে যেতে পারে। আর লবণাক্ততার কারণে নানা ধরনের উদ্ভিদ, গাছপালা ও পশুপাখি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদী এবং উপকূলীয় বাঁধ ও পোল্ডারগুলোর টেকসই নকশা প্রণয়নেরও পরামর্শ দিয়েছেন ড. সাইফুল ইসলাম।
গবেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ঘন ঘন নিম্নচাপের সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে উপকূলে সৃষ্টি হয় শক্তিশালী ঢেউ। এটি উপকূলের বালু সরিয়ে দেয় এবং ভাঙন তৈরি করে। অন্যান্য বছরের তুলনায় স্রোতের প্রকৃতি ও ঢেউয়ের তীব্রতা বেড়েছে।
ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বাঁধের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বালুমহাল ও পুকুর রাখা যাবে না। এতে পাড় ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় রাতের অন্ধকারে বালু তোলা হচ্ছে। ইজারা দেয়া হয় এক কিলোমিটার। কিন্তু বালু তোলা হচ্ছে তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এমনকি বাঁধ সংলগ্ন নদীর মাটির নিচের অংশ থেকেও বালু উত্তোলন করে ড্রেজিংকারী প্রতিষ্ঠান। অনেক সেতুর নিচ থেকে বালু তোলা হচ্ছে। এতে বাঁধ ও ব্রিজ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণে পাহাড় ও ফসলি জমির উর্বর মাটি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এতে পাহাড় ও ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই উর্বর মাটিরও অভাব রয়েছে। একই সঙ্গে বাঁধের জন্য জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘসূত্রতার কারণে যথাসময়ে বাঁধ নির্মাণও সম্ভব হয় না। তবে গবেষকরা বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। এজন্য মাটির বদলে সিমেন্ট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বলেন, ‘স্থানীয় জনসাধারণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক কারণেও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এজন্য সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। জনবলের ঘাটতি থাকায় সঠিকভাবে বাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। তবে আমরা বাঁধ ও পোল্ডারগুলো টেকসই করতে গুরুত্ব দিচ্ছি। বুয়েটের গবেষণা ও গবেষকদের পরামর্শগুলো বাস্তবিক রূপ দিতে জোর দেওয়া হবে।’
পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বাঁধ ও পোল্ডার ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রকল্প ও উদ্যোগ নিই। কিন্তু ২০২০-২১ সালে করোনার কারণে সেটি বাধাগ্রস্ত হয়। বাঁধ টেকসই করার ক্ষেত্রে নদী এলাকার বাসিন্দাদের মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে। বাঁধ রক্ষায় রোপণ করা গাছপালা কেটে নিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। আবার অনেকে মাটি নিয়ে যান বাড়িঘর নির্মাণের জন্য। তাই বাঁধ রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি নদী পাড়ের জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
বাঁধ ও পোল্ডারের এক কিলোমিটারের ভেতর পুকুর না রাখা এবং দেশীয় যন্ত্র দিয়ে নদী থেকে বালি উত্তোলন না করার কথাও বলেন প্রতিমন্ত্রী।
নদনদীতে থাকা বেড়িবাঁধ ও উপকূলীয় এলাকায় থাকা পোল্ডারগুলো নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণে স্যাটেলাইট ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন বুয়েটের ভিসি ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি বলেন, এখন প্রযুক্তি অনেক উন্নত। উন্নত বিশ্বে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে নজরদারি ও তদারকি করা হয়। আমাদেরও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আছে। এখন স্যাটেলাইট ইমেজিংয়ের মাধ্যমে নদী ও এর তীর কী পরিস্থিতিতে বা অবস্থায় আছে তা জানা সম্ভব। এর মাধ্যমে কেউ বাঁধের ক্ষতি করছে কি না তাও নজরদারি করা যাবে।’
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা আইপিসিসি’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসজনিত দুর্যোগের মাত্রা যত বাড়বে তত বেশি উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন ও উপার্জনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ পানি সংকটে পড়বে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকায় বন্যা বাড়বে।
Leave a Reply