ভুয়া কাজীর দৌরাত্ম্য

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, আগস্ট ৮, ২০২৩
  • 216 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ০৮ আগস্ট, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

নোয়াখালী জজকোর্ট ও আশপাশের এলাকায় ২০ বছর ধরে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রির কাজ করেন এক মফিজ (ছদ্মনাম)। প্রতি মাসে তিনি অন্তত ৩০টি বিয়ে ও তালাক ‘ রেজিস্ট্রি’ করেন। সে হিসেবে গত ২০ বছরে সাত হাজারের বেশি বিয়ে ও তালাক ‘ রেজিস্ট্রি’ করেছেন। তবে নোয়াখালী শহরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাজীদের তালিকায় মফিজের নাম নেই।

অনিবন্ধিত হয়েও কাজী হিসেবে প্রায় দুই যুগ ধরে কাজ চালিয়ে আসছেন তিনি। জজকোর্ট সংলগ্ন মসজিদের নিয়মিত মুসুল্লি ফজলুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রতি শুক্রবার তিন থেকে চারটি বিয়ে হয়। বেশিরভাগ বিয়ে হয় আসরের নামাজের পর। এ ছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনও কম-বেশি বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন হয়। সবগুলো বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করেন কাজী মফিজ। অন্যান্য কাজীদের চেয়ে তিনি কিছু টাকা কম রাখেন।

কেবল মফিজ নয়, আদালত চত্বরে কাজি পরিচয়ে বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন করছেন আরো কয়েক জন। এ ছাড়া আদালতে কর্মরত অনেক মুহুরিও কাজী পরিচয় দিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি ও তালাক নিবন্ধন কার্যক্রম করছেন। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় দেদার চলছে ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি ও তালাক নিবন্ধন।

একশ্রেণির দালাল ও এসব ভুয়া কাজী নিজেরাই সিল তৈরি করে কাবিননামার নকল বইয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রি করছেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এফিডেভিট করে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। এসব কাজী তাদের প্রয়োজনে নকল কাবিননামা, তালাকনামা ও বয়স প্রমাণের এফিডেভিটের ঘোষণাও দিচ্ছেন।

এতে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন আতঙ্কে রয়েছেন তেমনি পরকীয়ার বলি হচ্ছে প্রবাসীদের সংসার। চক্রটি অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও তাদের বিষয়ে নির্বিকার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নোয়াখালী শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেক ভাসমান কাজী। যাদের আইনগত বিয়ে নিবন্ধনের এখতিয়ার নেই।

কাজী হিসেবে নিয়োগ পেতে যেসব যোগ্যতা বা আইনের বিধিবিধান রয়েছে তার কোনোটাই তাদের নেই। নিবন্ধন ছাড়াই ভুয়া বিয়ে রেজিস্ট্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এসব নামসর্বস্ব কাজীর ফাঁদে পড়ে প্রতারিত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। কিছু অসাধু আইনজীবীর সহায়তায় এসব ভুয়া কাজী বিয়ে রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এদের অফিস আছে, নিয়মিত বিয়েও পড়াচ্ছেন। আছে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার, সরকার নির্ধারিত বালাম বইও। তবে সেটা ভুয়া। তাদের নেই আইনগত কোনো বৈধতাও। সেই সঙ্গে কাজীর নেই সরকারি নিবন্ধনও। তবুও এসব কথিত কাজী পরিচয়েই বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রি করছেন বছরের পর বছর।

জানা গেছে, নিকাহ-তালাক রেজিস্ট্রারদেও কেন্দ্রীয় কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ের হাতে নেই। কোন এলাকায় কাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তার তথ্য নেই। তাই সারাদেশে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে নিকাহ রেজিস্ট্রারদের কার্যক্রমে।

এমন অবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ, স্থায়ীকরণ, জবাবদিহিতা ও শাস্তি নিশ্চিতকরণের বিষয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে পুরোনো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিয়ে ও বিচ্ছেদ নিবন্ধিত হওয়ার জটিলতার উদ্ভব হচ্ছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। আইনজীবীরা বলছেন, বর্তমান সময়ে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণার প্রবণতা বেড়েছে। তথ্য গোপন করে একজন ব্যক্তি একাধিক বিয়ে করছে। তালাকও দিচ্ছে। এটা হওয়ার কারণ বিয়ে ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড না হওয়া।

আবার অনেক সময় নিবন্ধনহীন ভুয়া কাজীর মাধ্যমে বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি করে অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। বিয়ের বৈধতা না থাকায় পরবর্তীতে তারা আইনগত সুবিধা পাচ্ছে না। বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রারদের ডিজিটালাইজেশনের আগে প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রশ্ন রয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অবৈধ ও ভুয়া কাজীরা খুবই শক্তিশালী। তাদের আইনের আওতায় আনা অসম্ভব। কারণ তারা একটি সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করে। এতে সারাদেশের ভুয়া কাজীরা জড়িত আছে এবং সব একত্রিত হয়ে অর্থ ঢেলে মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করে।

তাদের বিরুদ্ধে বাল্যবিয়ে, ভুয়া বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রিসহ বেআইনিভাবে বিয়ে পড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেলেও ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এর আগেই তারা আদালতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রিট মামলা করেন। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর।

কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকার অনেক কাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে সাত হাজার ৯০০ জন কাজী রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই তালিকার বাইরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সব কাজী রয়েছেন তারা অবৈধ। বিভিন্ন এলাকায় রয়েছেন অগণিত ভাসমান কাজী। তাদের কোনো বৈধ সনদ বা ঠিকানা নেই।

ভুয়া কাজীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী জামাল উদ্দিন ভূঁঞা বলেন, অবৈধ ও ভুয়া বিয়ে এবং তালাক নিবন্ধনের দায়ে ওই কাজীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দন্ডবিধিতে আছে। দন্ডবিধির ৪১৭ ধারা অনুযায়ী কাজীর এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও অর্থদন্ড হতে পারে। নিবন্ধিত না হয়েও বৈধ কাজীর রূপ ধারণ করে কাজ করা প্রতারণার শামিল।

অপরদিকে মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী অনূর্ধ্ব দুই বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। তবে বিভিন্ন সময় ভুয়া কাজী ধরা পড়ার খবর গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু তাদের শাস্তি হয়েছে এমন নজির নেই। ভুয়া কাজীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এমন অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।

কাজীর তালিকা ও ভুয়া কাজীর শাস্তি না হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, এটা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা। অবিলম্বে মন্ত্রণালয়কে বিয়ে নিবন্ধক (কাজীদের) তালিকা, এরিয়ার তালিকা তৈরি করে অনলাইনে দিয়ে দেয়া দরকার। সদিচ্ছা থাকলে এই কাজটি এক মাসেই সম্ভব এবং তালিকার কপি, উপজেলা প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান এবং থানায়ও দিয়ে দেয়া যায়। খুব সাধারণ কাজ। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় এমন জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ উপেক্ষিত হয়ে আছে, এটা দুঃখজনক।

বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ রেজিস্ট্রার সমিতির একজন নেতা বলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর-কনের অনেক তথ্যই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। রেজিস্ট্রি পদ্ধতি এখনো এনালগ রয়ে গেছে। ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা গেলে ভুয়া কাজী সনাক্ত করা সহজ হতো। বৈবাহিক তথ্যের ডাটাবেজ থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যেত। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রান্তিক জনপদের অধিক্ষেত্রগুলোতে অনেক বয়স্ক নিকাহ রেজিস্ট্রার রয়েছে। তাদের অনেকেরই তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞান নেই।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!