দিশারী ডেস্ক। ৫ নভেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ ২০২৩ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার। অন্যদিকে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি বছর মৃত্যু হয় ১০ লাখ ৪১ হাজার ৩৩১ জনের।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৭ লাখ ৩০ হাজার ৯৩৬ জন বা অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু নিবন্ধন করা হয়েছে। ফলে ৩ লাখ ১০ হাজার ৩৯৫ জন বা প্রায় ৩০ শতাংশ মৃত ব্যক্তির মৃত্যু নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তির পুত্র বা কন্যা বা অভিভাবক বা নির্ধারিত ব্যক্তি মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুসংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধকের কাছে প্রদানের জন্য বাধ্য থাকবেন।
তবে পরিসংখ্যান বলছে, দেশে অন্তত ৩০ শতাংশ মৃতের পরিবার মৃত্যু নিবন্ধন করে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সনদ থাকাটা মৃত ব্যক্তির উত্তরসূরির জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যু সনদ না থাকলে নানা আইনি জটিলতা হতে পারে। অনেক মামলার বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ প্রমাণ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। জটিলতা তৈরি হয় সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রেও।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের অভিজিৎ বিশ্বাসের বাবা গোপাল বিশ্বাস (৯৫) মারা গেছেন প্রায় এক বছর আগে। তখন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদকে তিনি তা অবহিত করেননি। এক বছর পর জমি বিক্রির প্রয়োজন পড়লে তিনি জানতে পারেন, বাবার মৃত্যু সনদ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
অভিজিৎ বিশ্বাসের মতো মৃত্যু সনদের বাধ্যবাধকতার কথা জানতেন না রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের পশ্চিম মহিপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. নজরুল ইসলাম। তার মা ফজিলা বেগম এবং বাবা খতিব উদ্দিন মারা গেছেন যথাক্রমে ২০১৬ ও ২০২২ সালে। প্রয়োজন না হওয়ায় তিনিও এতদিন মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করেননি।
ডুমুরিয়ার শোভনা ইউনিয়নের সচিব উত্তম বিশ্বাস বলেন, জন্ম নিবন্ধনের মতো মৃত্যু নিবন্ধন নিতে নাগরিকরা একেবারেই অভ্যস্ত নন। তারা এটাকে খুব একটা প্রয়োজন মনে করেন না।
এছাড়া অনেক মৃত ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন না থাকায় মৃত্যু সনদ পেতে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। এসব কারণে মানুষের মধ্যে মৃত্যু সনদ নেয়ার আগ্রহ কম।
———————————————————————————————–
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, জন্ম নিবন্ধন করানোর জন্য নানা উদ্যোগ সরকার নিচ্ছে। শিশুর স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে অনেক জরুরি কাজে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের পরও কিন্তু আমরা জন্ম নিবন্ধন পুরোপুরি সফল করতে পারিনি। অন্যদিকে মৃত্যু নিবন্ধন নিয়ে সরকারের তেমন কোনো প্রচারণা নেই। সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগও নেই।
———————————————————————————————–
তিনি বলেন, ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর তার সম্পদের উত্তরসূরি না থাকলে অথবা তিনি বিত্তবান না হলে মৃত্যু সনদ গ্রহণে আগ্রহী কাউকে পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাবে পরিবারগুলো কাজটি করে না। ফলে এখানে সরকারের আরো মনোযোগী হতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে। এ-সংক্রান্ত শাখাগুলোকে আরো অগ্রসর ভূমিকা পালন করতে হবে।
দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিদের মধ্যে যখন স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি ভাগ হয়, তখন ওই ব্যক্তির মৃত্যু নিবন্ধন দরকার পড়ে। ব্যাংকে মৃত ব্যক্তির জমা রাখা অর্থ, লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অর্থ প্রাপ্তির জন্যও মৃত্যু সনদপত্র জমা দিতে হয়। মৃত ব্যক্তির জমিজমা, বাড়ি-গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানির মালিকানা ইত্যাদির ক্ষেত্রে নাম জারি করতে গেলে অথবা নিজের নামে সম্পদটি রেকর্ড করতে হলে এলাকার রেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিসে কাগজটি অবশ্যই জমা দিতে হয়। মৃত ব্যক্তি চাকরিজীবী হলে, অবসরপ্রাপ্ত হলে তার পেনশন ও অন্য সুবিধাদি দাবি করতে হলেও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন।
দেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, রেজিস্ট্রার অফিসে সরাসরি গিয়ে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ সংগ্রহের জন্য আবেদন করা যায়। বিদেশে অবস্থানকালে মৃত্যু নিবন্ধন করা যায় বাংলাদেশ দূতাবাসে। আবেদনের সুযোগ আছে অনলাইনেও। মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন করলে কোনো ফি প্রয়োজন নেই। এরপর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত ২৫ টাকা, আরো পরে করলে ৫০ টাকা ফি নির্ধারণ করা রয়েছে।
অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম মনে করেন, শুধু ব্যক্তির নিজের অথবা উত্তরাধিকারীদের প্রয়োজনে নয় ; সঠিক পদ্ধতিতে প্রত্যেক নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রাষ্ট্রের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, জন্ম ও মৃত্যু তথ্য সঠিকভাবে নিবন্ধন হলে দালিলিক অপরাধ কমে আসবে। রাষ্ট্রের কাছে জনগণের সঠিক তথ্য তাৎক্ষণিক বা প্রতিদিনের জনসংখ্যা প্রতিদিনই জানার সুযোগ তৈরি হবে। এর মাধ্যমে দেশে নারী কত, পুরুষ কত, সেটি যেমন জানা যাবে, তেমনি ঠিক কী কী কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, কোন বয়সের মানুষের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি, সেটি খুব সহজে জানা যাবে।
তিনি বলেন, জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য একটি রাষ্ট্রের শিক্ষা বলুন আর চিকিৎসা বলুন, সব ধরনের পরিকল্পনায় দরকার। সঠিক তথ্য না থাকলে আপনি কতজনের জন্য পরিকল্পনা নেবেন, কত অর্থ লাগবে, এসব তখন অনুমাননির্ভর একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে ১০ বছর পরপর আদমশুমারি হয়ে থাকে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে বহু মানুষ মারা যান। ফলে বছরজুড়ে নিয়মিত মৃত্যুর নিবন্ধন না হলে জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতির হিসাবে ভুল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। মৃত্যু নিবন্ধন না হলে জাল ভোটের ঝুঁকিও থাকে। সরকারের দেয়া বিভিন্ন ভাতার ক্ষেত্রে জালিয়াতির আশঙ্কা থাকে। জটিলতা সৃষ্টি হয় আইনি বিষয়েও।
————————————————————————————————–
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এনামুল হক বলেন, মৃত্যু সনদ না থাকলে আইনের দিক থেকে নানা জটিলতা তৈরি হয়। অনেক মামলার বিচারকাজে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। অনেক অপরাধ প্রমাণ করাও ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সম্পদ বণ্টন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। আবার মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে জানার জন্য, মৃত ব্যক্তির কবর কোথায় আছে সেটি জানার জন্যও নিবন্ধন জরুরি। আমি মনে করি, মৃত ব্যক্তির কবরের রসিদের আলোকে নিবন্ধন করে নিলে সবচেয়ে ভালো হয়।
————————————————————————————————
Leave a Reply