দেশে অস্ত্রোপচারের হার বেড়েছে বাড়েনি অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট

  • আপডেট সময় বুধবার, মার্চ ৫, ২০২৫
  • 12 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ৫ মার্চ ২০২৫ ।

বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ৪৩ বছর বয়সী আরিফুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পেশায় স্থপতি আরিফুল ইসলাম লিভারের সমস্যায় ভুগছেন। তিনি জানান, দেশে লিভারের ভালো চিকিৎসা না থাকায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে হায়দরাবাদের একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করানো হয় তার। এরপর পাঁচবার ফলোআপ ট্রিটমেন্টের জন্য সেখানে যেতে হয়েছে তাকে।

কিন্তু গত বছরের অক্টোবরে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি আর চিকিৎসা করাতে পারছেন না। দালালের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার ভিসা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তার মতো আরো অনেকে রয়েছেন, যারা এখন ভারতে যেতে না পেরে দেশেই অস্ত্রোপচার করাচ্ছেন।

হার্নিয়ার অসুখ নিয়ে গত জানুয়ারিতে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন মনিরুজ্জামান মল্লিক। ১৬ জানুয়ারি অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল তার।

হার্নিয়ার অসুখ নিয়ে গত জানুয়ারিতে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন মনিরুজ্জামান মল্লিক। ১৬ জানুয়ারি অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল তার। এজন্য সকাল সাড়ে ৭টার সময় ওই হাসপাতালের একজন নার্স তার ওপর একটি চেতনানাশক ইনজেকশন প্রয়োগ করেন। এর ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই ওই রোগীর মৃত্যু হয়। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, চেতনানাশক অ্যানেস্থেসিয়ার প্রয়োগ অস্ত্রোপচার কক্ষেই করার কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের উপস্থিতিতে এ ধরনের ইনজেকশন দেয়ার কথা থাকলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক ছিল না বলে দাবি রোগীর স্বজনদের।

অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর ওপর চেতনানাশক প্রয়োগে এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর নানা ধরনের বিপত্তি বা মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোটা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের (অবেদনবিদ) সংকটের কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থানের পর ভারত গমনে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় দেশে গুরুতর অস্ত্রোপচারের চাহিদা এখন ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এতে হাসপাতালগুলোয় অবেদনবিদের সংকট এখন আরো তীব্র হয়েছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও পেইন ফিজিশিয়ানসের (বিএসএসিসিপিপি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন তালিকাভুক্ত বিশেষজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আছেন ১ হাজার ৯৫২ জন। এর বাইরে আছেন আরো পাঁচ শতাধিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। কিন্তু দেশের স্বাভাবিক চাহিদা বিবেচনায় এ সংখ্যা যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বিএসএসিসিপিপির কার্যকরী পরিষদ সদস্য ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন বলেন, দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোয় যে পরিমাণ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পদ রয়েছে, সে অনুপাতে সার্জনের সংখ্যা বেশি। অধিক অপারেশনে স্বল্পসংখ্যক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট কাজ করছেন, যে কারণে তাদের ওপরে কাজের চাপ রয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে প্রশিক্ষণ বা সনদ ছাড়াই অনেকে অ্যানেস্থেসিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। আবার নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়েও যুক্ত হয়েছেন অনেকে। এসব কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পদ যেমন বাড়ানো দরকার, একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার জন্য চিকিৎসকদের আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়াটাও এখন সময়ের দাবি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অভ্যুত্থানের পর দেশে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের চাহিদা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশটিতে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা তৈরি হওয়ায় দেশের হাসপাতালগুলোয় অস্ত্রোপচার বা জটিল চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের চাপও বেড়েছে।

চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো হাসপাতালে এখন অভিজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের জায়গায় দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমাধারীদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল এ কাজটি করানো হচ্ছে অদক্ষ নার্সদের দিয়ে। ফলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় অস্ত্রোপচারের হার বেড়েছে তুলনামূলক বেশি। রাজধানীর স্কয়ার, ইবনে সিনা, এভারকেয়ার, ল্যাবএইড, বিআরবি হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে গত কয়েক মাসে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউসহ বিভিন্ন সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রেও অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে সবখানেই এখন প্রয়োজন পড়ছে অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের।

——————————————————

সৌজন্যে : ভিন্ন দৈনিক

—————————————————

এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের প্রয়োজন বেশি পড়ছে জানিয়ে স্কয়ার হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট ডা. এমএম জায়েদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণত যে হারে আমাদের দেশে অস্ত্রোপচার হয়, বিভিন্ন করপোরেট হাসপাতালে এখন তার প্রায় দ্বিগুণ অপারেশন হচ্ছে। যারা আগে পার্শ্ববর্তী দেশে যেতেন, কিন্তু এখন যেতে পারছেন না ; এমন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে ক্যান্সার রোগীরা ও ট্রান্সপ্লান্টের রোগীরা এসব হাসপাতালে ফলোআপের জন্য বেশি আসছে। অস্ত্রোপচারের তুলনায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় অপ্রতুল। এদিকে, কাজের তুলনায় বেতন অনেক কম হওয়ায় নতুন নতুন বিশেষজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট যোগদান করছেন না। বেতন বৈষম্যের কারণেও অনেক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এখন আগ্রহ হারাচ্ছেন।

মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এখন অবেদন বিদ্যায় শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহ ব্যাপক মাত্রায় কমেছে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো প্রাইভেট চেম্বার করে রোগী দেখার সুযোগ না থাকা, উপযুক্ত ফি না পাওয়া, সার্জনদের ওপর নির্ভরশীলতাসহ নানা কারণে তারা এখন আর এ বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী হচ্ছেন না।

এ বিষয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক সাজিদ বিন আজাদ বলেন, দেশের সব টারশিয়ারি হাসপাতালে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, অবকাঠামো ও ফ্যাসিলিটিজের অভাব, কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি, জনগণের অ্যানেস্থেসিয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব—নানা কারণেই তরুণ চিকিৎসকরা এ পেশায় ক্যারিয়ার করতে অনুৎসাহিত হচ্ছেন। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও সার্জন একে অন্যের ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশেষজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হাসপাতালগুলোয় সেবার মানকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। অথচ পেরিফেরিতে অদক্ষ ও অবৈধ তথাকথিত ‘ অজ্ঞান ডাক্তারদের ’ আনাগোনা প্রচুর। এতে করে বিপন্ন হচ্ছে সুচিকিৎসা, প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে পড়ছেন সংশ্লিষ্ট রোগীরা। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে সুনজর দেয়া প্রয়োজন।

অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সার্জন এবং অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের মধ্যে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। ফলে তাদের অনেকেই পেশাগত বিশেষায়নে পরিবর্তন আনছেন। এ বিষয়ে বিএসএসিসিপিপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শামসুল আরেফিন সুমন বলেন, সব হসপিটালে সব ডাক্তারের বিলবোর্ডে নাম থাকে বা স্ক্রলিংয়ে আসে।

কিন্তু অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের নাম আসে না। এ বৈষম্য কেন ? রোগীরা কি জানতে পারছে, তাদের অ্যানেস্থেসিয়া কোন টিম বা কারা দিচ্ছে ? এটা এক ধরনের অসম্মান। ২০০৮ সালে একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট যে বেতনে চাকরিতে যোগদান করেছেন, এখনো সে একই বেতন। আর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর হিসাব হলো, ভালো লাগলে চাকরি করবেন, না পোষালে ছেড়ে যাবেন। এ অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে এ বিষয়ে দিন দিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, যেটা আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য প্রচণ্ড হুমকিস্বরূপ। তারা হয়তো কেউ পেইন মেডিসিন, কেউ প্যালিয়েটিভে নিজেদের কেরিয়ার সুইচ করছেন, কিন্তু অ্যানেস্থেসিয়ায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা থাকতে চাচ্ছেন না।

যদিও দক্ষ-অভিজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও সম্মানী দেয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. এএম শামীম।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বেশি অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট দরকার। কেননা, বর্তমান সবকিছুতেই অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের দরকার হয়। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান ছিল, বর্তমানে তার চেয়ে অনেক গুণ ভালো অবস্থানে তারা আছেন। হাসপাতাল মালিক ও ব্যবস্থাপকদের কাছে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের গুরুত্ব অনেক বেশি। সার্জনদের পূর্ণকালীন নিয়োগ না দিলেও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের পূর্ণকালীন নিয়োগ দেয়া হয়। সার্জন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের একইভাবে মূল্যায়ন করা হয়। আমরা সব সময় দক্ষ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট খুঁজি। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট চিকিৎসকদের দক্ষতা বাড়ানো এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে অধ্যয়নে মনোযোগী হওয়া জরুরি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!