সংবাদমাধ্যম , সাংবাদিক চরিত্র ও গত দুই দশক

  • আপডেট সময় বুধবার, মে ১২, ২০২১
  • 704 পাঠক

————–
সম্পাদকীয় নোট
————–

গত দুই দশকে সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশ তার গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। এরমধ্যে বেসরকারি টেলিভিশন এসেছে। এসেছে অনলাইন সংবাদমাধ্যমও। যত বেশি সংবাদমাধ্যম এসেছে, তত বেশি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে।

শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সাংবাদিকরাও দলীয় সাংবাদিকে পরিণত হয়েছেন। আগে যেমন দলীয় মুখপত্র ছিল এখন তেমন দলীয় সাংবাদিকও আছেন। আর সংবাদমাধ্যমগুলোও দলীয় বিবেচনায় সংবাদ পরিবেশন করছে। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না।

সাংবাদিকরাও তাদের মর্যাদার জায়গাটি হারাচ্ছেন। তাই এখন দলবাজ-দলদাস সাংবাদিক পদবাচ্য দু’টি খুব শোনা যায়।

এই কারণেই সংবাদমাধ্যমে এখন পেশাদার সাংবাদিকের অভাব দেখা দিচ্ছে। এজন্য সাংবাদিক নিজে যেমন দায়ী তেমনি তার প্রতিষ্ঠান, মালিকপক্ষ এবং সম্পাদকও দায়ী। মালিকপক্ষ সাধারণ বিবেচনায় ব্যবসা দেখে। ক্ষমতার সিঁড়ি বানায়।

ফলে মালিকপক্ষের ব্যবসায়িক ও ক্ষমতার স্বার্থের অনুগামী সম্পাদক তো আর পেশাদার সাংবাদিকতার জন্য কাজ করেন না। তিনি মালিককে গুডবুকে রেখে সম্পাদক পদে থাকার জন্যই কাজ করেন। ফলে দিন দিন অপেশাদারদের বাজার বড় হচ্ছে।

আর এটাই তৈরি করছে সংবাদমাধ্যমে নেতৃত্বের সংকট। নেতৃত্বের সংকট যেখানে তৈরি হয় সেখানে সৃজনশীলতা ও মানের সংকট দেখা দেয়। সম্পাদক যদি সংবাদমাধ্যমের মূলসূত্রের বাইরে গিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান, আর ক্ষমতাবান হওয়ার চেষ্টা করেন, সাংবাদিক যদি তার দলীয় লোকজনকে খুশি করার খবরের পেছনে ছোটেন, প্রকাশক বা মালিক যদি সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করেন অন্য ব্যবসা ও ক্ষমতার ভিত শক্ত করার কাজ করেন, তাহলে দেশে সংবাদমাধ্যমের যে চরিত্র দাঁড়ায়, তা হলো ক্ষমতামুখী সংবাদমাধ্যম। গণমুখী নয়।

যে সংবাদমাধ্যম গণমুখী নয়, তা কখনোই সাধারণ মানুষের আস্থায় থাকে না।
এর ফলে সময়ের সঙ্গে সংবাদমাধ্যম এগোতে পারে না। স্থবির হয়ে পড়ে। সৃজনশীলতা থাকে না। থাকে না অনুসন্ধান। সাংবাদিকতা পিআর জার্নালিজমে পরিণত হয়। পরিণত হয় এমবেডেড জার্নালিজমে। যার বাংলায় নাম দেয়া যেতে পারে শয্যাশায়ী সাংবাদিকতা।

আর এ কারণেই অনলাইন সাংবাদিকতাকে আমরা এখনও ঠিকমতো ধরতে পারছি না। এখানে বড় বিনিয়োগ আসে না। আসে কপিপেস্ট সাংবাদিকতা। টুকটাক অনলাইন।
সংবাদমাধ্যমের ব্যর্থতাই ফেক নিউজকে জনপ্রিয় করে। ভুয়া অনলাইন বাজার পায়।

সংবাদমাধ্যম যখন আস্থার জায়গায় থাকে না তখন মানুষ গুজবকে বিশ্বাস করে। অসত্য তথ্য বা মেকিং ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মানুষ নিঃশ্বাস নেয়ার জানালা খোঁজে। তাই তো ফেসবুক লাইভ দেখতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন ফেসবুকে। কিন্তু টেলিভিশন দর্শক পায় না।

এর ফলে এখন বিজ্ঞাপন সংকটে ভুগছে সংবাদমাধ্যম। বিজ্ঞাপন কম হওয়া মানে আয় কম হওয়া। আর আয় কম হলে তা পোষানোর সহজ পথ হলো ছাঁটাই করা। ছাঁটাইয়ের এই কোপে এখন সবার আগে পড়ছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা।

বিজ্ঞাপনদাতারা এখন প্রচলিত সংবাদমাধ্যম থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমেরই বিজ্ঞাপনের আয় তেমন নেই। তবে বিজ্ঞাপন বাড়ছে বিকল্প মাধ্যমে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবে। ওসব মাধ্যমে গত বছর কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন গেছে। শুধু টেলকো থেকেই বিজ্ঞাপন গেছে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকার।

আর বিজ্ঞাপনের এই ট্রেন্ড ধরার জন্যও প্রয়োজন স্বাধীন ও পেশাদার গণমাধ্যম। সব কিছুকে মাল্টিমিডয়ার এক প্ল্যাটফর্মে আনার যে চ্যালেঞ্জ সেটা নিতে পারলেই এসব সংকট কাটানো সম্ভব। আর তা পারে কেবল পেশাদার সংবাদমাধ্যম।

এখন অনেকে হয়তো বলবেন, সংবাদমাধ্যম তো চাপের মুখে আছে। তার তো হাত-পা বাঁধা। এটা আমার কাছে অজুহাত বলে মনে হয়। আমি বলবো, চাপ সবসময়ই ছিল।
বিশ্বের কোথাও কখনও সংবাদমাধ্যম চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে তার টিকে থাকার জন্যই পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে। জনগণের, গ্রাহকের আস্থায় থাকতে হবে। এটাকেই একটি স্বাধীন ব্যবসা হিসেবে দেখতে হবে।

সংবাদমাধ্যম অন্য ব্যবসা বা অন্য ধরনের ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হলে স্বাভাবিকভাবেই পরগাছায় পরিণত হবে।

আমাদের এখানে অনেকটা তা-ই হয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, এখানে স্বেচ্ছা আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত আছেন অনেকেই। এখন আর চাপ দিতে হয় না। জোর করে দাসত্ব নয়, স্বেচ্ছা দাসত্বের চর্চা শুরু হয়েছে। আমাদের কেউ কেউ এখন মনোদাস। তার ফলও আমরা দেখতে শুরু করেছি।

তা হলো দলবাজ সাংবাদিকতা। সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকের কোনও দল বা কোনও দলের প্রতি সমর্থনকে আমি খারাপ বলে মনে করি না। কিন্তু সেটা সংবাদমাধ্যম বা সংবাদ পরিবেশনে যদি প্রভাব ফেলে তাহলে সেটা দলবাজি।

আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমই আছে, যারা প্রকাশ্যেই কোনও দলকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সংবাদে তার কোনও প্রতিফলন থাকে না। থাকে না দলবাজি। থাকে না মতলববাজি।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!