—————————————
“সম্পর্ক তৈরি করার আগে নিশ্চিত হন,
আপনি তার প্রিয়জন, নাকি প্রয়োজন”।
একটা মর্ম স্পর্শী কথা পেলাম “কেউ ভুলে যায় না! প্রয়ােজন শেষ…… তাই আর যােগাযােগ রাখে না”। খুব ছোট একটা লেখা অথচ কেমন করে যেন শূন্য বুকটাতে আঘাত করে যায়।
ভেতরের আজন্ম লালিত নির্বোধ কষ্টটা কেমন করে যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। হয়তো এটাই জীবনবোধের বোঝা টানা উপকথার কাহিনী। রূপকথার গল্পের সাথে জীবনবোধের ঠান্ডা লড়াই।
এই জীবনবোধের গভীরতা থেকে এপিজে আব্দুল কালাম আজাদ তাই বলেছেন, “সম্পর্ক তৈরি করার আগে নিশ্চিত হন, আপনি তার প্রিয়জন, নাকি প্রয়োজন”। কিন্তু বাস্তবের মানুষকে চেনাটা এতটা সহজ নয়। মানুষ খুব সন্তর্পনে মানুষের ভেতরে ঢুকে পড়ে, একটা মায়াবী চশমা চোখে লাগিয়ে ধীরে ধীরে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে।
তারপর একদিন মানুষের বুক থেকে কলজেটা বের করে নিয়ে বিশ্বাসকে হত্যা করে। স্বার্থপর পৃথিবীর মানুষরা এমনই হয়। সব সময় সামনের দিকটা দেখে, পেছনের দিকটা দেখে না। যেমন স্বার্থপর মানুষ দীপ্যমান সূর্যের সামনের দিকটা দেখে। রাতের আঁধারে চাঁদের মায়াবী রূপকে দেখে। অথচ এদের পেছনের অদেখা পৃথিবীটা দেখে না।
যে মানুষটা একদিন পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল, যেদিন তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় সেদিন মানুষ সেই মূল্যহীন হয়ে পড়া মানুষটার আর খোঁজ নেয় না। অকৃতজ্ঞ মানুষ বিবেকহীন আনন্দের শূন্যতায় ঝুলে থাকে, সেটাকে মানুষ জীবনের কোলাহলভাবে।
বাণিজ্যিক পৃথিবীতে তার স্বার্থের জয় ভাবে। অথচ এই আত্মমগ্নতা মানুষের ভিতরের মনুষ্যত্বকে ক্রমাগতভাবে নিঃশেষ করে দেয়। সেখানে আর মানুষ থাকে না, সেখানে মানুষের পরিবর্তে জন্ম হয় অস্থিমজ্জাহীন কংকালদের।
আমি আবেগতাড়িত হয়ে কথাগুলো বলছি না। বরং জীবনের অচলায়তন ভেঙে মানুষের ভেতরের মানুষের অনেক গভীরে থাকা একবিন্দু পাপের অনুতাপ থেকে উত্তাপ ছড়ানো অদেখা বাস্তবতা থেকে বলছি। মানুষ সব দেখতে পায় না।
যে মানুষটা অন্যের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তার একটা একাকিত্বের পৃথিবী তৈরী হয়। সে পৃথিবীর রাজা হয় মানুষটা। তার কোনো রাজা থাকে না। যারা তাকে ত্যাগ করে চলে যায় তারা তার প্রজা হয়ে যায়। এই দর্শনতত্বটা খুব অদ্ভুত। যা মনস্তত্বের জটিলতাকেও হার মানায়।
যে বাবা-মা তিলে তিলে সন্তানদের বড় করে, সেই সন্তানরা উন্নত জীবনের মোহ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। বাবা-মা অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে দেশের মাটিতে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষদের সে সময় সন্তানদের হাত ধরে ওঠে দাঁড়াবার খুব প্রয়োজন হয়। সেটা আর কপালে জুটে না। সন্তান যত বড় হয় বাবা-মায়ের সাথে বন্ধনটাও তত দুর্বল হয়। তখন আবেগ প্রযুক্তির বেগের কাছে হার মানে।
কি আপন, কি পর। সবাই যে খুব স্বার্থপর হয়। কিসের ভালোবাসার বন্ধন, কিসের নাড়ির টান। হয়তো সেগুলো বইয়ের পাতায় লেখা কতগুলো নির্বাক শব্দ, অর্থহীন মহান বাণী।
আধুনিক প্রযুক্তির একটা মোবাইল ফোনে বিদেশে থাকা সন্তানরা বাবা-মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে। কি আর এমন ঘটে, কিছু না। আর আট-দশটা মৃত্যুর মতো বাবা-মায়ের না ফেরার দেশে চলে যাওয়াটা একটা খবর হয়।
তারপর একদিন সময়ের গর্ভে চাপা পড়ে যায় সম্পর্কের অদৃশ্য সুতোর টানগুলো। যারা দেশে থাকে সে সন্তানরা নিজেদের সংসার গড়ে। সে রঙিন সংসারে সাদাকালো যুগের বাবা-মায়েরা কেমন যেন ব্যাক ডেটেড হয়ে যায়। বাবা-মা এক একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
দামি দামি ফার্নিচার, শোপিচ, গাড়ি, বাড়ি, মোবাইল সবকিছুর সাথে বাবা-মা কেমন যেন বেমানান হয়ে পড়ে। কারণ মানুষের কাছে বস্তুবাদী, ভোগবাদী চিন্তাটা এখন যতটা বড়, মানবতাবাদী চিন্তাটা ততটাই ছোট।
যান্ত্রিক মানুষ বাবা-মায়ের তথাকথিত সুখের চিন্তা করে বাবা-মাকে বৃদ্বাশ্রমে রেখে আসে অথচ সে সুখের অসুখে সে আক্রান্ত হয়। তারপর যার যার তার তার মতো জীবন। এরপর আর কোনোদিন সন্তানদের মুখ দেখেনা বাবা-মা।
শিক্ষা নাকি মানুষকে মহত করে, উদার করে, অনেক বড় করে। কিসের কি? যে যত শিক্ষিত হয় সে তত সম্পর্কগুলোকে পদদলিত করে। একটা গরিব অশিক্ষিত মানুষ তার বাবা-মাকে যতটা আগলে রাখে, একটা শিক্ষিত সাহেব গোছের মানুষ ততটাই তার বাবা-মায়ের অবহেলা করে।
এই দলছুট সমীকরণটা মেলানো খুব কঠিন। বাবা-মা যখন সন্তানের প্রয়োজন ছিল, তখন হয়তো তারা প্রিয়জন ছিল। প্রয়োজন যদি প্রিয়জন বানায় তবে প্রিয়জনের আমরা যে নাটক সাজিয়েছি সে নাটকের যবনিকাপাত ঘটানো দরকার। কারণ শেষ থেকেই আবার উপলব্ধির যাত্রা শুরু হয়।
একতরফা সন্তাদের দোষ দেয়াটা যৌক্তিক হবে না।আধুনিক পৃথিবীর বাবা-মা এখন নিজেদের স্বার্থের কারণে সন্তানদের অবহেলা করছে। ইট পাথরের প্রাচীরে প্রতিদিন একটার পর একটা সংসারে বাবা-মায়ের সম্পর্কের ফাটল ধরছে। ছোট ছোট সন্তানরা বাবা-মায়ের এই বিচ্ছেদে একা হয়ে পড়ছে।
একটা মমতাহীন পৃথিবীতে সন্তানদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, অভিমান আর আবেগের যেন কোনো মূল্য নেই। ভোগবাদী পৃথিবী বাবা-মাকেও কেমন যেন উন্মাদ করে দিচ্ছে। ছোট ছোট সন্তানদের চেয়ে তাদের নিজেদের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠছে। সব যেন উল্টে পাল্টে সভ্যতাকে পিছনে টেনে ধরছে।
জানিনা আমার এমন চিন্তাকে কেউ প্রাচীন বলবে কিনা। কারণ আমরা যাকে প্রাচীন বলছি সেটাই আধুনিকতা আর যেটাকে আধুনিকতা বলছি সেটাই প্রাচীন। বাস্তবে মানুষ তার মনস্তত্ত্বে যে চিন্তার বীজ বুনছে সেখানে একটা অস্থিরতার বলয় তৈরী হয়েছে। সে বলয় যেটা মানুষকে ভাবা দরকার সেটা ভাবতে দিচ্ছেন বরং যেটা ভাবা উচিত নয় সেটাই ভাবাচ্ছে।
একজন ছাত্রের একটা মূল্যবান কথা কেমন করে যেন মনকে নাড়া দিয়ে গেলো। সে লিখেছে, “উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে এসে বুঝেছি শিক্ষার অবহেলা। আমাদের দেশের শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষিত করা হয় না।
একটা ডিগ্রী দেবার জন্যই শিক্ষা দেওয়া হয়”। তাহলে আমাদের শিক্ষায় গলদ আছে। যেখানে মুখস্ত বিদ্যায় মানুষকে পারদর্শী করা হলেও তার নতুন চিন্তার স্বকীয়তাকে প্রাধান্য দেয়া হয় না।
প্রকৃত শিক্ষা অন্ধকারে অবহেলায় পড়ে থাকছে আর যে শিক্ষা মানুষকে মানুষ বানাতে পারছেনা সে শিক্ষার সাথে আমাদের সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। একই ভাবে শিক্ষার মতো জীবনের জন্য যে অপরিহার্য উপাদানগুলো রয়েছে সেগুলোর ঠিক যেভাবে মানুষের সাথে সম্পর্কিত হবার কথা ছিল তা হচ্ছে না।
সততা, সহমর্মিতা ও উদারতার সাথে মানুষ সম্পর্ক গড়ছেনা বরং অসততা, অসহিষ্ণুতা, কুপমুন্ডকতার সাথে মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠছে। সমাজের ভালো ও সৃজনশীল মানুষটি মানুষের দ্বারা উপেক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতা, অর্থ আর পেশিশক্তির প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়ে নেতিবাচক শক্তির সাথে সম্পর্ক গড়ছে।
মানুষ মানুষের উদারতাকে দুর্বলতা ভাবছে আর অবৈধতাকে শক্তির উৎস ভাবছে। ধীরে ধীরে বিনয়, কৃতজ্ঞতাবোধ, আনুগত্য, সদাচারণ নির্বাসিত হচ্ছে। সত্যরা ক্রমশ কোনঠাসা হচ্ছে, মিথ্যারা ক্রমাগত ফণা তুলে উঠছে।
গুণীদের সমাজে যত কদর কমছে, নির্বোধ গলাবাজদের তত কদর বাড়ছে। সংখ্যাধিক্যের জোরে যুক্তি, বিজ্ঞান ও পান্ডিত্যের পরাজয় ঘটানো হচ্ছে।
এতো সব অন্ধকার, পশ্চাদ্গামিতা, চিন্তার সংকীর্ণতা মানুষকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরেছে। তারপরও নিঃসঙ্গ আলো অন্ধকারের ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে আলোর যে তারাবাতি জ্বালাতে চায় তাকে রুখবে এমন শুভবোধের শক্তি আর কার আছে।
একটুকরো সোনা আগেও যেমন মূল্যবান থাকে তেমনি সব সময় মূল্যবান থাকে। যে মানুষটা মানুষের প্রয়োজন হয়ে প্রিয়জন হয়ে ওঠে সে মানুষটা জানে মানুষ তাকে প্রয়োজন মনে করে, প্রিয়জন নয়। সে মনে মনে হাসে, নীরবে কাঁদে।
তারপরও সবাই একে একে তাকে ফেলে গেলেও তার পৃথিবীতে সবাই প্রিয়জন হয়েই থাকে। কারণ সে তখন তার পৃথিবীর রাজা হয়ে ওঠে। আর সে রাজার কাছে সব প্রজারা সব সময় মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। তারপরও কথা থাকে……তবে সে কথার কোনো উত্তর থাকে না।
মানুষের মানুষকে দেখার চোখ একরকম হয়না, সত্যকে দেখার চোখ একরকম হয়না, সম্পর্ককে দেখার চোখ একরকম হয় না। এটার একটাই কারণ হতে পারে তা হলো একজন মানুষের মন থেকে আরেকজন মানুষের মন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সবকিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় হয়তো বা কিন্তু মানুষকে নিয়ে কখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।
রাজনীতিতে যেমন শেষ কথা বলে কিছু নেই, মানুষকে নিয়েও শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে মানুষ রাজনীতির মতো হোক এমনটা আমরা চাই না, মানুষ মানুষের মতন হোক এমনটাই আমরা চাই।
Leave a Reply