—————
ভারতে মুসলিমরা কিছু উগ্রপন্থি হিন্দুর হাতে অত্যাচারিত হচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব মুসলিমকে হত্যা করছে তারা। কখনো রাস্তাঘাটে নারীদের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করা হচ্ছে।
একটি ঘটনায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া একজন মুসলিম শিক্ষার্থীকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। ফেরিওয়ালাদের প্রহার করা হয়েছে। তাদেরকে হিন্দুদের গ্রামে যেতে বারণ করে দিয়েছে তারা।
এসব নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাকিস্তান সংস্করণ এক্সপ্রেস ট্রিবিউন একটি প্রতিবেদন লিখেছে।
তাতে বলা হয়েছে, ঠিক এক সপ্তাহ আগের কথা। ভারতের মধ্যপ্রদেশের নিমাচ জেলায় হিন্দুদের একদল দাঙ্গাকারী রাতের বেলা কিছু মুসলিমের ওপর আক্রমণ করে।
তারা একটি মাজারে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন নারীও। ভারতীয় মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, রাতভর ওইসব মুসলিমকে প্রহার করা হয়েছে। এরপর মাজার ত্যাগ করার আগে হামলাকারীরা ওই মাজারের অংশবিশেষ উড়িয়ে দিয়ে যায়।
এ ঘটনার দেড় মাস আগে উজ্জয়ন জেলার সেকলি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু তরুণ ভাঙারি ব্যবসার ডিলার আবদুল রশিদকে বেধড়ক মারপিট করে। তাকে হুমকি দেয়া হয়- এটা হিন্দুদের গ্রাম। তাকে যেন ওই গ্রামে আর দেখা না যায়। এরপর আতঙ্কিত রশিদ আর ওই গ্রামে যাননি। এতে তার কাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিবিসি’কে তিনি বলেছেন, এই এলাকায় আমি ২০ বছর ধরে কাজ করি। এ ছাড়া আমরা আশপাশের গ্রামগুলোতেও যাই। কিন্তু এর আগে কেউ আমাদেরকে থামায়নি। কিন্তু এবার আমাকে বেশ কিছু যুবক প্রহার করেছে। আমার ব্যবসার জিনিপত্র দূরে ছুড়ে ফেলেছে। আর স্লোগান দিয়েছে- জয়শ্রীরাম।
উজ্জয়ন জেলার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, পরিত্যক্ত জিনিসের ডিলারদের ওপর এমন হামলা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এসব বিষয়ে এতদিন কেউ জানতো না। তিনি আরো বলেন, আবদুল রশিদের ওপর হামলার ভিডিও ধারণ করে হামলাকারীরা নিজেরাই এবং তারাই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়, যা ভাইরাল হয়েছে।
এ নিয়ে রিপোর্ট হয়েছে। এখন মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন হচ্ছে। আগে এমনটা ছিল না। ছয় দিন আগে, একজন মুসলিম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছাত্রের দেহকে খণ্ড বিখণ্ড করা হয়। এরপর তা ব্যাঙ্গালোরে একটি রেললাইনের ওপর ফেলে রাখা হয়। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন যুবতীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
স্থানীয় হিন্দুদের একটি কট্টরপন্থি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চুক্তিতে উপনীত হয় যে, তিনি ও ওই যুবতীর মধ্যে প্রেমের সম্পর্কের ইতি ঘটবে। চুক্তি সত্ত্বেও ওই ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় হিন্দুদের ওই সংগঠনের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এই তিনটি ঘটনার সঙ্গে গত কিছুদিনে মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হরিআনা, কর্নাটক এবং অন্য অনেক রাজ্যে ও স্থানে ধর্মীয় ঘৃণাপ্রসূত হামলার শিকারে পরিণত হয়েছেন মুসলিম ব্যবসায়ীরা। কিছু পর্যবেক্ষক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু মুসলিমরাই অনিরাপদ মনে করছেন এমন না। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও প্রভাবশালী কট্টরপন্থি হিন্দু মানসিকতার প্রভাবে রয়েছে।
এমন ঘৃণাপ্রসূত ঘটনার সূত্রপাত ২০১৭ সালে। তখন প্রকাশ্য দিনের বেলায় রাজস্থানের আলওয়ার জেলায় একটি হাইওয়েতে একজন মুসলিমকে হত্যা করে কট্টরপন্থি হিন্দুরা। ‘গোরক্ষা’র সঙ্গে কাজ করছিলেন এমন সংগঠনের সদস্যরা রাস্তায় তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ওই এলাকায় একটি ডেইরি ফার্মের মালিক ছিলেন পাহলভি খান হারি।
তিনি স্থানীয় বাজার থেকে একটি গরু কিনেছিলেন। পাহলভিকে হত্যার বিষয়ে স্থানীয় একজন সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়ের খান বিবিসিকে বলেছেন, ওই হত্যার ফলে স্থানীয় মানুষদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছে।
আমরা যারা আলওয়ার, রেওয়ারি, পালোল, গুরগাঁও অথবা ফরিদাবাদ থেকে আসি, তাদের মধ্যে সব সময় একটি ভয় থাকে। তা হলো পাহলভি খানের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে একই ঘটনা আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষক আরিফা খানম বলেছেন, কিছু হামলা ধারাবাহিকভাবে চালানো হয়েছে। কিছু ঘটেছে বিক্ষিপ্ত অবস্থায়। তিনি আরো বলেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক প্রচারণা আছে। প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে প্রতিবেশীকে লাগিয়ে দিতে উস্কানি দেয়া হচ্ছে।
দেশের যে মূলনীতি তাকে পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এসবের সঙ্গে জড়িত কট্টরপন্থি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)।
সম্প্রতি ব্যাপক সংখ্যক মুসলিম সবজি বিক্রেতা হকারের ওপর হামলা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মিডিয়া সচেতন হয়েছে কিনা অথবা মুসলিমদের অর্থনীতিতে কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা?
এ প্রশ্নের জবাবে আরিফা বলেন, এমনিতেই মুসলিমরা প্রান্তিক পর্যায়ে রয়েছেন। কারণ, তারা দরিদ্র এবং সংখ্যালঘু। এখন মুসলিমদেরকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমান অবস্থায় ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা আরো বেশি অনিরাপদ মনে করছেন। আমার মনে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কিছু অংশ ধর্মীয় উগ্রবাদে ঝুঁকে পড়েছে। উগ্রপন্থা যেকোনো দেশের জন্যই অত্যন্ত বিপজ্জনক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিমদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কারণ, হামলাকারীরা মনে করেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না সরকার। এমন কিছু ঘটনা আছে যেখানে ভিকটিমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
শীর্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকার রজনী বকশী ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে এমন সহিংসতাকে দেখা হয় হিন্দুদের জন্য ন্যায়বিচার হিসেবে।
কিন্তু প্রকৃত কথা হলো, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় চোখ বন্ধ করে আছে প্রশাসন। এসব ঘটনায় মুসলিমদের মধ্যে অনিরাপত্তার একটি ভাবধারা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নয়া দিল্লির একজন শিক্ষার্থী ফারহিন সাইফি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন আমরা এসব ঘটনা দেখি, আমাদের হৃদয়ে ভয় জেঁকে বসে। কারণ, একই ঘটনা আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
ঝাড়খণ্ডের শিক্ষার্থী আহমেদ আনসারি মনে করেন, এসব সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা উচিত।
অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের শিক্ষার্থী নারগিস খাতুন উদ্বেগ তুলে ধরেন অবনতিশীল পরিস্থিতিতে। বলেন, আমাকে পথেঘাটে চলতে হয়। হিজাব পরতে হয়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়নি। কোনো বৈষম্যের শিকারে পরিণত হইনি। আমি মনে করি এখনও মানুষের মনে মুসলিমদের জন্য শ্রদ্ধা আছে।
কিন্তু দিল্লিভিত্তিক সমাজকর্মী আয়মান রিজভির আছে ভিন্ন অভিজ্ঞতা। তিনি হিজাব পরেন। বলেন, যখন ওইসব মানুষ কারো মুখে দাড়ি দেখে, মাথায় টুপি দেখে, একটি মেয়েকে বোরকা পরা অবস্থায় দেখে, তখন তাদেরকে ধর্ম নিয়ে মস্করা করতে শুরু করে।
আমি হিজাব পরার কারণে আমাকে ‘টেন্ট হাউজ’ ডাকা হয়েছে। এসব ঘটনায় সরকার কি ব্যবস্থা নিচ্ছে? প্রশ্ন করেন তিনি।
Leave a Reply