বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ২৪ শতাংশ মিঠাপানির প্রজাতি

  • আপডেট সময় শনিবার, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
  • 11 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ফসলের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, শিল্প-কারখানার বর্জ্য দূষণ, পরিবেশগত বিপর্যয়, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহারসহ নানা কারণে দিন দিন দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তি ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ মিঠাপানির প্রজাতি।

জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের সিংহভাগই বর্ষার পানিতে মিশে মুক্ত জলাশয়ে চলে আসে। এর ফলে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। একইসঙ্গে শামুক, কাঁকড়া ও অন্যান্য জলজ প্রাণীও ব্যাপকহারে বিনষ্ট হচ্ছে।

—————————————————————

গবেষণা প্রতিবেদন

————————————————————–

মৎস্য ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারেন্ট জাল ও বাদাই জাল দিয়ে এক শ্রেণির জেলে যে হারে নদী-নালা, খাল-বিল-হাওর থেকে দল বেঁধে হানা দিয়ে ছেঁকে তুলে নিচ্ছে দেশি প্রজাতির পোনা মাছ, মা মাছ আর মাছের প্রজননকালীন সুস্বাদু খাদ্য ক্ষুদ্র জলজ উপজীব ও প্রাণী।

তারা বলছেন, এই শ্রেণির জেলেকে ‘ সাবাড় বাহিনী ’ বলা হয়। চলনবিল এলাকায় এ সাবাড় বাহিনীর দৌরাত্ম্য বেশি দেখা যায়। অসাধু এসব জেলের এ ধরনের মৎস্য আহরণ অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে একসময় দেশের নদ-নদীতে মাছের মারাত্মক সংকট দেখা দেবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিলুপ্ত ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ মিঠাপানির প্রজাতি। গত ২৫ জানুয়ারি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘ নেচার ’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় ওঠে এসেছে এমন তথ্য। প্রায় ২৪ হাজার মিঠাপানির প্রজাতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রায় এক হাজার প্রজাতি মারাত্মকভাবে বিপন্ন। যার মধ্যে প্রায় ২০০ প্রজাতি সম্ভবত এরইমধ্যে বিলুপ্তও হয়ে গেছে। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে আগামী কয়েক দশকে মাছ, কাঁকড়া থেকে শুরু করে গঙ্গা-ফড়িং, শামুকসহ হাজার হাজার মিঠাপানির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশের মিঠাপানির ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সর্বশেষ ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট মাছের ৬৪ প্রজাতি বা ২৫.৩ শতাংশ ‘হুমকির মুখে’ রয়েছে।

পানি, খাবার ও সম্পদের জন্য মানুষের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী, হ্রদ ও জলাভূমির মতো মিঠাপানির পরিবেশ চাপের মুখে পড়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।

গবেষণা বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিঠাপানির বাস্তুতন্ত্র। তবে মিঠাপানির প্রাণীরা বর্তমানে সবচেয়ে বিপন্নও বটে। মিঠাপানির প্রজাতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক সহযোগিতা ও পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। মিঠাপানির বাস্তুতন্ত্র ছোট হলেও পৃথিবীতে প্রাণের জন্য এদের গুরুত্ব অপরিসীম।

এ গবেষণার প্রধান লেখক ক্যাথরিন সায়ার বলেছেন, মিঠাপানির জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব বাস্তুতন্ত্র প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ের জন্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এদের সুরক্ষায় আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে ম্যানগ্রোভ ও লবণাক্ত জলাভূমির মতো জলাভূমি, যেখানে ১৭০০ সাল থেকে ভারতের সমান আয়তনের প্রায় ৩৪ কোটি বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়ে গেছে।

এটি কেবল প্রাণী প্রজাতিরই ক্ষতি করছে না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই ও বন্যা ঠেকাতে আমাদের ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে।

পানি উত্তোলন ও বাঁধের কারণে বিভিন্ন নদীও আকারে ছোট হয়ে আসছে। কলোরাডো নদীর মতো কিছু নদী আর সমুদ্রে প্রবাহিত হয় না। আর যা-ও অবশিষ্ট রয়েছে, তা বেশিরভাগই পয়োনিষ্কাশন, শিল্পবর্জ্য ও প্লাস্টিকের মাধ্যমে দূষিত হচ্ছে।

কীটনাশকসহ কৃষিজমি থেকে আসা পানি মিঠাপানির প্রাণী প্রজাতির জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। এসব চ্যালেঞ্জের পরও মহাসাগরের তুলনায় কম গবেষণা হয় মিঠাপানির বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্র নিয়ে। ফলে অনেক প্রজাতি প্রয়োজনীয় সহায়তা ছাড়াই টিকে আছে।

প্রাণী সংরক্ষণ পরিকল্পনায় মিঠাপানির প্রজাতি যোগ করার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন এ গবেষণার সহ-লেখক ড. টপিল্টজিন কনট্রেরাস ম্যাকবিথ। তিনি বলেছেন, বন্যপ্রাণী ও মানুষ উভয়ের সুস্থ থাকার জন্যই এসব বাস্তুতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও সুরক্ষায় আমাদের আরও বিনিয়োগের প্রয়োজন।

বাংলাদেশ বিগত ১৪ বছরে ২৯ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মিঠাপানির মাছ পুনরুদ্ধার, নতুন স্থাপিত লাইভ জিন ব্যাংকে সেগুলো সংরক্ষণ এবং অন্যান্য সংকটাপন্ন বিপন্ন জাতের সঙ্গে সেগুলো পুনরুৎপাদন করেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা।

কোন কোন প্রাণী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে

গবেষণায় ডেক্যাপডস, ওডোনেটস, মলাস্ক ও মাছ– এ চারটি দলের মিঠাপানির প্রাণী প্রজাতির ওপর নজর দেন গবেষকরা। এরা বেঁচে থাকে মিঠাপানির আবাসস্থলের ওপর নির্ভর করে।

ডেক্যাপডস : এ দলে কাঁকড়া, চিংড়ি ও ক্রাইফিশ প্রজাতির প্রাণীরা রয়েছে, যার প্রায় ৩০ শতাংশ প্রজাতি বর্তমানে হুমকির মুখে। কীটনাশক দূষণের কারণে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এরা।

ওডোনেটস : বসবাসের উপযোগী জায়গা কমে যাওয়ায় ঝুঁকিতে আছে গঙ্গা-ফড়িং ও ফড়িং, যার অর্ধেকেরও বেশি বিপন্ন প্রজাতির ওপর প্রভাব পড়ছে কৃষিকাজ ও কাঠ কাটার মাধ্যমে জলাভূমি ধ্বংসের কারণে।

মলাস্ক : গবেষণায় এ দলটি নিয়ে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা না হলেও আগের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মিঠাপানির শামুক ও ঝিনুকের মতো মলাস্ক প্রজাতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাণী বিলুপ্ত ঝুঁকিতে রয়েছে।

মাছ : দূষণ ও আবাসস্থল ধ্বংসের বিষয়টি মিঠাপানির মাছেরও ক্ষতি করছে, যা এদের বেড়ে ওঠা ও প্রজননের ওপর প্রভাব ফেলছে।

মিঠাপানির প্রজাতি রক্ষায় প্রয়োজন বৈশ্বিক সহযোগিতা ও পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। সরকার, বিজ্ঞানী ও বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে অবশ্যই দূষণ কমাতে, প্রাণীদের আবাসস্থল পুনরুদ্ধার এবং এদের সংরক্ষণ কৌশল তৈরিতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মিঠাপানির বাস্তুতন্ত্র ছোট হলেও পৃথিবীতে প্রাণের জন্য এদের গুরুত্ব অপরিসীম।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!