ঐক্য ও বিভেদ নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী ?

  • আপডেট সময় সোমবার, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫
  • 22 পাঠক

ইফতেখারুল হক হাসনাইন
০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ 

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘ আর সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)

এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। মূলনীতি হলো, প্রত্যেক মুমিনকে নিজের ব্যক্তিগত মতামত ত্যাগ করে শুধু আল্লাহর বিধান ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহকে প্রাধান্য দিতে হবে। যখন সবার লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি, তখন মতপার্থক্য ও বিভেদের অবকাশ থাকবে না।

মতপার্থক্য ও বিভেদের মধ্যে পার্থক্য

মানুষের স্বভাব ও চিন্তাধারা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় মতপার্থক্য স্বাভাবিক। তবে মতপার্থক্য তখনই গ্রহণযোগ্য, যখন সবার মূলনীতিতে ঐক্য থাকে, কিন্তু শাখাগত বিষয়ে ভিন্ন মত থাকে। যেমন—ফিকহের ক্ষেত্রে ইমামরা বিভিন্ন মত দিয়েছেন, কিন্তু সবার লক্ষ্য ছিল কোরআন-সুন্নাহের অনুসরণ। অন্যদিকে, বিভেদ বা বিচ্ছিন্নতা তখনই সৃষ্টি হয়, যখন কেউ সত্যকে অস্বীকার করে এবং নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে জিদ ধরে।

দ্বিনের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান রাখা অপরিহার্য। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশকে অস্বীকার করা, আখিরাতকে অস্বীকার করা বা দ্বিনের কোনো মৌলিক বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করা—এসবই বিভেদ সৃষ্টি করে, যা কুফরের শামিল।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় ও বলে, আমরা কতক (রাসুল)-এর প্রতি তো ঈমান রাখি এবং কতককে অস্বীকার করি, আর (এভাবে) তারা (কুফর ও ঈমানের মাঝখানে) মাঝামাঝি একটি পথ অবলম্বন করতে চায়। এরূপ লোকই সত্যিকারের কাফির। আর আমি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৫০-১৫১)

ঐক্যের মর্মার্থ

ঐক্য মানে এই নয় যে সবাই একই পদ্ধতিতে আমল করবে। বরং ঐক্য হলো, সবাই আল্লাহর বিধান ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহকে কেন্দ্রীয় স্থান দেবে। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনুযায়ী খালেস মনে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করবে। যদি কেউ আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে রাসুল (সা.)-এর মর্মার্থ অনুযায়ী সঠিক ব্যাখ্যা করে এবং তা দ্বিনের মৌলিক নীতির বিরোধী না হয়, তবে তার ব্যাখ্যা সঠিক।
তবে এটাও মনে রাখা জরুরি যে একজনের ব্যাখ্যা যেমন হতে পারে, অন্যজন তার চেয়ে উত্তম ব্যাখ্যা দিতে পারে। এটি বিভেদ নয়, বরং এটি এমন একটি পার্থক্য, যা উম্মতের জন্য রহমতস্বরূপ।

ইসলামের শিক্ষা ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা

ইসলাম মানুষের হৃদয়কে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ আমার নিয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তখন আল্লাহ তোমাদের হৃদয়কে এক করে দিলেন এবং তাঁর রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করলেন।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)

ইসলাম আগমনের আগে আরব সমাজে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ও হানাহানি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু ইসলাম তাদেরকে একত্র করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করল। তারা পরস্পর শত্রু থেকে পরস্পর ভাই হয়ে গেল।

ঐক্যের মাপকাঠি

ঐক্যের মাপকাঠি হলো, সবাই শুধু আল্লাহর আনুগত্য করবে এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। যখন মানুষ একে অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে না, একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা না করে, বরং সবাই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে, তখন এটি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বড় নিদর্শন।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ এবং তোমরা সেই সব লোকের (অর্থাৎ ইহুদি ও নাসারার) মতো হয়ো না, যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি আসার পরও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং আপসে মতভেদ সৃষ্টি করেছিল। এরূপ লোকদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৫)

আল্লাহওয়ালাদের সংসর্গের প্রভাব

আল্লাহওয়ালাদের সংসর্গে মানুষের মনে এই গুণ তৈরি হয় যে সে অন্য মুসলিমকে মুসলিম হিসেবে মেনে নেয় এবং এতটাও নরম হয় না যে কুফরকে কুফর বলতে দ্বিধা করে।

ইসলামের শিক্ষা হলো, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা। আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা থেকে দূরে থাকাই মুমিনের কর্তব্য। প্রত্যেক মুমিনের উচিত নিজের ব্যক্তিগত মতামত ত্যাগ করে শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

লেখক : মুহাদ্দিস, আল জামিয়াতুল কাওমিয়া দারুল হিকমাহ, সাভার, ঢাকা।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!