আতাউর রহমান খসরু। ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।
রাষ্ট্রের প্রাণস্পন্দন জনগণ। জনসাধারণকে ঘিরেই আবর্তিত হয় রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম। তাই ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনায় জনসম্পৃক্ততাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করে। ইসলামের শিক্ষা হলো শাসক রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন জনগণের মতামত ও মনোভাবকে গুরুত্ব দেবে, তেমনি জনসাধারণের মধ্যে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করবে। কেননা ইনসাফই জনসম্পৃক্তর গণভিত্তি।
ইসলামী রাষ্ট্রে জনসম্পৃক্তর ধারণা
ইসলাম রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের মতো প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার কথা যেমন বলে, তেমন সুবিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জনের তাগিদও প্রদান করে। কেননা প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার মতো মানসিক সম্পৃক্ততাও গুরুত্বপূর্ণ, বরং ক্ষেত্রেবিশেষ মনোসংযোগ ও সংহতি বাহ্যিক সম্পৃক্ততার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য ইসলাম একদিকে যেমন বলেছে, ‘ যারা তাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দেয়, নামাজ আদায় করে, নিজেদের পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৩৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি জনসাধারণের কোনো দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলো এবং দুর্বল ও অসহায় মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে, কিয়ামতের দিন তার আড়ালে থাকবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২০৭৬)
অন্যদিকে আল্লাহ বলছেন, ‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আমানত তার হকদারকে প্রত্যর্পণ করতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উত্কৃষ্ট! আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
জনসম্পৃক্তর গুরুত্ব
রাষ্ট্র পরিচালনায় জনসম্পৃক্তর গুরুত্ব নানাভাবে প্রমাণিত। যেমন—
১. জনগণ রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান : রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্যতম প্রধান ও মৌলিক উপাদান জনগণ। তাই রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের মতামতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আর কোরআনে রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদানগুলোকে গুরুত্ব দিতেই শেখায়। পরাক্রমশালী ন্যায়পরায়ণ শাসক জুলকারনাইন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ আমি তাকে পৃথিবীতে কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের উপায়-উপকরণ দান করেছিলাম। ’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ৮৪)
২. প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ : মানুষের প্রকৃতি হলো প্রতিকূল শক্তিকে সে সহযোগিতা করে না, বরং সুযোগ পেলে বিদ্রোহ করে। তাই শাসকের উচিত হলো গণমানুষের চাহিদা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ তুমি আল্লাহর বিধানে কখনো কোনো পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানের কোনো ব্যতিক্রমও দেখবে না।’ (সুরা : ফাতির, আয়াত : ৪৩)
রাষ্ট্রের সঙ্গে জনসম্পৃক্তর নানা দিক
ইসলাম রাষ্ট্রের সঙ্গে জনসম্পৃক্ত তৈরির যেসব নির্দেশনা দিয়েছে তার কয়েকটি হলো—
১. জনগণের কথা শোনা : শাসক জনসাধারণের কথা শুনবে। এ জন্য ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসক ও নাগরিকের ভেতর কোনো মাধ্যম বা প্রতিবন্ধক অনুমোদিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ যে ব্যক্তি জনসাধারণের কোনো দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলো এবং দুর্বল ও অসহায় মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে, কিয়ামতের দিন তার আড়ালে থাকবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২০৭৬)
২. জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া : খলিফা উমর (রা.)-এর যুগে কুফার গভর্নর সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর ব্যাপারে অভিযোগ আসে যে পৃথক ভবন নির্মাণ করেছেন এবং তাতে দরজা লাগিয়েছেন, ফলে জনসাধারণ চাইলেই তাঁর কাছে যেতে পারে না। তখন উমর (রা.) তাকে মদিনায় ডেকে পাঠান। (তারিখে তাবারি : ৩/১৫০)
৩. পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ : ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মূলনীতি হলো পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ যারা তাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দেয়, নামাজ আদায় করে, নিজেদের পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে।’ (সুরা : আশ-শুরা, আয়াত : ৩৮)
তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সবার পরামর্শ ও মতামতের মূল্য সমান নয়। যারা আল্লাহভীতি, প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞান, ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তার অধিকারী মতামত প্রদানে তারা অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী হবে।
৪. যোগ্য প্রশাসক নিযুক্ত করা : শাসকদের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগদানে যোগ্য ব্যক্তিকে বেছে নেওয়া, বিশেষ করে পদের প্রতি লালায়িত ব্যক্তিকে নিয়োগ না দেয়া। আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর দুজন সঙ্গী যখন রাসুল (সা.)-এর কাছে প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করে, তখন তিনি তাদের বলেন, ‘ আমরা আমাদের কাজে এমন কাউকে নিযুক্ত করি না, যে পদ চেয়ে নেয়। আর এমন ব্যক্তিকেও নয়, যে পদের লোভ করে বা তার প্রত্যাশা করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭১৪৯)
৫. ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত করা : ন্যায়বিচার ও সমতা জনসাধারণের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলে এবং শাসকদের সঙ্গে জনগণের সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ তোমাদের পূর্বের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর হদ জারি করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা চুরি করত তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৭৫)
৬. শাসকের নৈতিক দৃঢ়তা নিশ্চিত করা : শাসক নীতি-নৈতিকতার ওপর সুদৃঢ় না থাকলে জনগণ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে না এবং রাষ্ট্র ও জনসাধারণের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয় ইসলামের এই কল্যাণকর ধারা কত দিন অব্যাহত থাকবে। তিনি উত্তর দেন, যত দিন তোমাদের নেতারা নীতি-নৈতিকতার ওপর অটল থাকবে। (আল ওয়াহাম ওয়াল ইহাম : ২/২৭৪)
আলী (রা.) উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ আপনি সৎ আছেন বলেই আপনার প্রজারা সৎ আছে। আর আপনি প্রবৃত্তির অনুসরণ করলে তারাও প্রবৃত্তির অনুসরণ করত।’ (আল ইমামাতুল উজমা, পৃষ্ঠা-৩৭২)
৭. অন্যায় ও অপরাধীদের দমন : অন্যায় ও অন্যায়কারীদের দমন না করলে মানুষ জুলুমের শিকার হবে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। সর্বোপরি তা রাষ্ট্রের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে।
আমর (রহ.) হুসাম (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘ যে জাতির মধ্যে পাপ কাজ হতে থাকে, এগুলো বন্ধ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ করছে না, অচিরেই আল্লাহ তাদের সবাইকে চরম শাস্তি দেবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৩৩৮)
৮. অঙ্গীকার রক্ষা করা : শাসকরা আল্লাহ, তাঁর রাসুল, জনগণ ও রাষ্ট্রের প্রতি যেসব অঙ্গীকার করে থাকেন তা রক্ষা করা জরুরি। নতুবা তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীতে পরিণত হবে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ অতঃপর যে তা (অঙ্গীকার) ভঙ্গ করে তা ভঙ্গ করার পরিণাম তারই এবং যে আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার পূর্ণ করে তিনি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দেন।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ১০)
৯. শক্তি প্রয়োগ নয়, সমঝোতা : রাষ্ট্রের কোনো জনগোষ্ঠী যদি শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়, তবে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে সমঝোতার পথ অনুসরণ করবে। কেননা শক্তি প্রয়োগ জনসাধারণকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘ তারা উভয়ে নিষ্কৃতি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৫)
১০. দ্বিনি অনুসরণ করা : মুসলিম রাষ্ট্রনায়করা শুধু বাহ্যিক উপকরণের ওপর নির্ভর করবে না, তারা মহান আল্লাহর বিধান মেনে চলবে এবং তার সাহায্য কামনা করবে। যেমন শোআইব (আ.) স্বজাতির উদ্দেশে বলেন, ‘ আমি তো আমার সাধ্যমতো সংশোধন করতে চাই। আমার কার্যসাধনা তো আল্লাহরই সাহায্যে; আমি তাঁর ওপর নির্ভর করি এবং আমি তাঁরই অভিমুখী।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮৮)
আল্লাহ সবাইকে দ্বিনের পথে চলার তাওফিক দিন। আমিন।
Leave a Reply