——————-
মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে অনিরাপদ হয়ে পড়ছে জীবন। আগামী দিনে এমন অবস্থা দাঁড়াবে যেখানে সেলফভর্তি অ্যান্টিবায়োটিক থাকবে— তবে রোগীর দেহে তা কার্যকারিতা দেখাবে না।
ফলে দিন দিন মানুষের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে অ্যান্টিবায়োটিক। বিভিন্ন রোগে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ফার্মেসিগুলো দেদার বিক্রি করছে অ্যান্টিবায়োটিক।
মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে জীবাণুর মধ্যে। ফলে প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে রোগবালাই। দেখা দিচ্ছে, নতুন মহামারি হিসেবে। এমন উদ্ভট পরিস্থিতি এড়াতে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার ও চেনা সহজ করতে এবার ওষুধের মোড়কে লাল রং দিয়ে চিহ্ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। তারপরও সংশয় থেকেই যাচ্ছে— এতকিছুর পরও অ্যান্টিবায়োটিকের সুফল মিলবে তো।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের এলোমেলো ব্যবহার করলে ক্ষতি তো হবেই। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয় কোন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে। যদি এলোমেলোভাবে প্রয়োগ হয়, তাহলে এটা পরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স হয়ে যাবে। যেখানে সাধারণ ওষুধ কাজ করত, পরে দেখা যাবে সেটা আর হচ্ছে না। তখন আরো দামি অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে। এতে জটিলতা তৈরি হবে, রোগীর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, এগুলো তো সমস্যা হবে।
নয়া শতাব্দীর সঙ্গে আলাপকালে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রায় এক শতাব্দী ধরে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ এবং ধ্বংস করতে সহায়তা করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার এবং অপব্যবহারের কারণে কিছু ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএতে ছোট পরিবর্তন (মিউটেশন) ঘটে এমন ‘সুপারবাগ’ তৈরি হচ্ছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজ করে না। ফলে আইসিইউতে মৃত্যুর ৮০ শতাংশ ঘটে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে। তাদের মতে, খুব দ্রুত যদি এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হয় তাহলে রোগ বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠবে।
রাজধানীর ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা বলছে, গত দুই বছরে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। উপর্যুপরি মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে এখন আর সেটি জীবাণু মারতে পারছে না। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে সামগ্রিক পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
জানা গেছে, ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে সর্দি-কাশির মতো জীবাণুবাহিত সংক্রমণেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। ফার্মেসির দোকানদার, পল্লী চিকিৎসক সবাই নিজের মতো করে অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে রোগীদের। কোন রোগের কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, কোন মেয়াদে দিতে হবে— তা না জেনেই চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন।
বর্তমানে বাজারে প্রচলিত ২০-২৫ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। এর মধ্যে অন্তত ১৭টির কার্যক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার ফার্মেসিতে কোনো ধরনের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। অথচ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করার নিয়ম নেই। অবশ্য বিষয়টি নজরদারি করারও কেউ নেই।
একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রেসক্রিপশনে তারা অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, তবে বেশিরভাগ রোগীই পূর্ণমেয়াদে তা ব্যবহার করেন না। দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ার কারণে রোগ একটু ভালো হলেই রোগীরা মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে শরীরে যে জীবাণু থাকছে তা ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে।
এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কেনা ও সেবন বাড়ছে। সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকিতে শিশু এবং হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীরা।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. এম এ হাবিব বলেন, বর্তমানে আইসিইউতে প্রায়ই সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থাকে অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ রোগীর। ফলে রোগীর শরীরের অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। কিছু রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করলেও তা তার শরীরে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। শুধু আইসিইউ, সিসিইউর রোগীরাই নয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের শরীরেই এখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে জীবাণু।
সূত্রমতে, সারাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষ অপচিকিৎসক কিংবা অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তির পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। আর বছরে সাড়ে ৩৬ কোটি মানুষ দুই থেকে তিনবার বিভিন্ন দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে থাকেন। মাত্র ৫ কোটি মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে— এরই মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ৫৬ শতাংশ মানুষের শরীরে কার্যকারিতা হারিয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের গবেষকরা বলছেন, মূলত চার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে। তা হলো— বিনা প্রেসক্রিপশনে ঘনঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, সম্পূর্ণ কোর্স শেষ না করে মাঝপথে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করা, প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার ও ভাইরাসজনিত কোনো অসুখে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এমনি সেরে যেত সেগুলোর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা নয়া শতাব্দীকে বলেন, খুবই ভয়ের কথা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। যখন তখন খাওয়ার প্রবণতা যদি রোধ করতে না পারি, তাহলে আমাদের সামনে ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারে এখন আর কাজ করছে না। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির কোনো নীতিমালা নেই। কিছু নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো বিক্রেতা বা ক্রেতা কেউই মানে না।
বিভিন্ন সময় গবেষণায় দেখা গেছে, যে কোনো আইসিইউতে প্রায়ই সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থাকে অন্তত ২৫-৩০ শতাংশ রোগীর। তখন অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেয়া হয় বা শক্তিশালী কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। এ রোগীগুলোর জন্য বিকল্প কিছুই থাকে না। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বাড়ছে।
রাজধানীতে শতকরা ৫৫ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ রোগ-জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। এক থেকে চার বছরের শিশুদের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার সর্বোচ্চ। ভুল ব্যবহার হয় বেশি।
জানতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান জানান, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ওভার দ্য কাউন্টার বিক্রি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রাণিসম্পদ খাতে, বিশেষ করে হাঁস-মুরগি ও মৎস্য চাষে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সব হাসপাতালে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
তিনি বলেন, ৫০টিরও বেশি জেলায় জীবাণুরোধী সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশনে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টিবায়োটিক লেখেন। তবে এটা করা উচিত নয়। এগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এছাড়াও অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় অসংখ্য রোগী কিনে সেবন করছেন। সর্বশেষ তথ্য ও বিশ্লেষণ দেখা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গার মতো বাংলাদেশেও নীরবে উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠছে ‘সুপারবাগ’। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ফলে সাধারণ সর্দি-জ্বর, কাটাছেঁড়া থেকে বড় ইনফেকশন, সবকিছুই রূপ নিচ্ছে মরণব্যাধিতে, কাজ করছে না কোনো ওষুধ।
ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, যারা অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে সবাই কোয়ালিফাইড ডাক্তার না। নন কোয়ালিফাইড ডাক্তারও অনেক আছে। এছাড়ও ফার্মেসিগুলোও ডাক্তারি করে, সবাই মিলে ওষুধ দেয়। এটাও ঠিক না।
প্রধানমন্ত্রীর এই চিকিৎসক বলেন, অনেক সময় গরিব লোকেরা যেখানে-সেখানে ডাক্তারকে দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন নেয়। হয়তো তাদের সামর্থ্য নেই বা হয়তো আছে। আবার রোগীদের আরেকটা অসুবিধা হলো ওষুধ খেয়ে একটু ভালো হলে বন্ধ করে দেয়। এটাও ক্ষতিকর। কারণ পুরো একটা কোর্স খেতে হবে। আবার দোকানদার যারা অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করে তারা অধিক মুনাফার জন্য, ব্যবসার স্বার্থে বিক্রি করে। কোর্স কমপ্লিট না করলে তো কোনো কাজ করবে না। পরে আবার অসুখটা ফিরে আসবে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরিস্থিতি যথেষ্ট ভয়াবহ। বিশেষত বহু মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে সরাসরি ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে। তাদের ধারণাই নেই। এর ফলে তার শরীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোনো সংক্রমণ হলে আর কোনো ওষুধে হয়তো সারবে না।
তিনি বলেন, এখন কোনো রোগ হলেই রোগী প্রথমে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে চায়। প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক না থাকলে বলে ডাক্তার ভালো না। তাই বাধ্য হয়ে অনেকে লেখেন। অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে জীবাণুগুলোর বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের জিনগত পরিবর্তন করে। জীবাণুটি আগের মতো একই রোগ সৃষ্টি করলে প্রচলিত যে অ্যান্টিবায়োটিক ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করত তা আর কাজ করে না। এই অবস্থায় জীবাণু পৌঁছে গেলে তাকে চিকিৎসার ভাষায় বলা হয় ‘সুপারবাগ’। অর্থাৎ এই ‘সুপারবাগেই’ এখন আমরা মরতে বসেছি।
Leave a Reply