মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
১৩ জানুয়ারি, ২০২৩
———————
বর্তমানে প্রাচুর্য যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে অভিযোগ ও অনুযোগ। অধিকাংশ মানুষের অন্তরে নেই প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা। ফলে দেখা যায় অপ্রাপ্তির হাহাকার। আমার এটা নেই, ওটা নেই। ভালো থেকেও সন্তুষ্ট নয়, শুধু আরও চাই। চাইতে চাইতে মানুষের জীবনকাল শেষ হয়ে যায়। আসলে অকৃতজ্ঞ ও অসন্তুষ্ট মন কখনো সুখী হতে পারে না। বরং যে অল্পতে সন্তুষ্ট থাকে, আল্লাহর দয়া ও দানের কৃতজ্ঞতা আদায় করে সে-ই প্রকৃত সুখী ও আল্লাহর নেয়ামতে সমৃদ্ধ। আল্লাহ তার প্রতি খুশি হয়ে খুলে দেন আসমানের বারিধারা।
আল্লাহর শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা আদায় করাও এক ধরনের নেয়ামত। অর্থাৎ এই নেয়ামত টেনে আনে অসংখ্য নেয়ামত। কৃতজ্ঞতার গুণ সবাই অর্জন করতে পারে না। সমাজে ‘নাই নাই’ করা লোকের সংখ্যাই বেশি। তারা একটিবারও ভাবেন না যতটুকু আল্লাহ দিয়েছেন, ততটুকুর জন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
আল্লাহ কৃতজ্ঞ বান্দাদের পছন্দ করেন। অকৃতজ্ঞদের জন্য তাঁর আজাবের হুঁশিয়ারি রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের আরও বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয়ই আমার আজাব বড় কঠিন’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা-ই পছন্দ করেন।’ (সুরা জুমার : ৭)
আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় মুমিনের অন্যতম গুণ। কারণ মুমিন তকদিরে বিশ্বাস করে। তকদিরের ভালোমন্দ দুটোই পার্থিব জীবনে পরীক্ষা হিসেবে আসে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে পরকালে মিলবে মহান আল্লাহর পুরস্কার, জান্নাতের অপার্থিব নেয়ামত। হাদিসে এসেছে, ‘মুমিনের বিষয়াদি কত আশ্চর্যের! তার সবকিছুই কল্যাণকর। আর এটা তো কেবল মুমিনের ক্ষেত্রেই হতে পারে। সচ্ছলতায় সে শুকরিয়া আদায় করে, তখন তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তার ওপর কোনো বিপদ নেমে আসে তাহলে সে সবর করে, ফলে তা-ও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়’ (মুসলিম : ২৯৯৯)। অর্থাৎ শোকর করলেও একটি সওয়াব হয়, সবর করলেও একটি সওয়াব হয়। উভয় অবস্থায়ই মুমিন সওয়াব উপার্জন করতে পারে। আর পরকালে কাজে আসবে শুধু সওয়াব। তাই মুমিন সুখে-দুঃখে, সচ্ছলতায়-দারিদ্র্যে, আনন্দে-কষ্টে পরকালের পুঁজি সংগ্রহের প্রতি মনোযোগী থাকে। অভিযোগ থাকে অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার।
দুঃখজনক হলেও সত্য, মানুষ তার প্রভুর প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ। অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে মানুষের দিনাতিপাত। পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গুনতে চাও তাহলে তা গুনে শেষ করতে পারবে না’ (সুরা ইবরাহিম : ১৪)। অথচ সামান্য এদিক-ওদিক হলেই মহান সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করতে বাধে না। মানুষের এই অকৃতজ্ঞতা স্বয়ং আল্লাহর অজানা নয়।
তিনি বলেছেন, ‘আর অবশ্যই আমি তো তোমাদের জমিনে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তাতে তোমাদের জন্য রেখেছি জীবনের উপকরণ। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো’ (সুরা আরাফ : ১০)। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সবচেয়ে উত্তম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন বিশ্বনবী (সা.)। তাঁর সব গুনাহ মাফ হলেও তিনি রাত জেগে ইবাদত করতেন। দুই পা ফুলে যেত। তারপরও সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শেষ ছিল না। আমরা একটুতেই ভেঙে পড়ি। অথচ আমরা যদি বিশ্বনবী (সা.)-এর চরিত্র দেখি, তাঁর জীবনযাপনে চোখ বোলাই, তাহলে ঈমান দৃঢ় হবে, অন্তরে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের হিম্মত পয়দা হবে, জীবন সুন্দর ও আনন্দময় হবে। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান জীবন লাভে নবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের বিকল্প নেই।
আত্মনির্ভরশীল জীবনের প্রতি ইসলাম বরাবরই উৎসাহ দিয়ে আসছে। প্রয়োজনীয় সম্পদ উপার্জনকে আল্লাহ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সালাত শেষ হয়ে গেলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহে জীবিকা অন্বেষণ করো, তথা উপার্জন করো’ (সুরা জুমা : ১০)।
হাদিসে বারবার হালাল উপার্জনের কথা এসেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দুহাতের উপার্জিত হালাল খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর কিছুই নেই’ (বুখারি)। তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল জীবিকার মাধ্যমে নিজে ও পরিবার-পরিজন প্রতিপালনের চেষ্টা করে সে আল্লাহর পথে সংগ্রামরত ব্যক্তির মতো’ (মিশকাত)। অবশ্যই সৎভাবে আয় বাড়ানোর চেষ্টা দোষের কিছু নয়।
কিন্তু অসৎপথে উপার্জন নয়। সারা জীবন অসৎ আয় করে সুখ ও প্রশান্তি খোঁজ করা মরুভূমিতে সবুজ ফসলের খোঁজ করার মতোই। আয় হালাল না হলে সুখ আসে না। দৃশ্যত গাড়ি, বাড়ি, ধন-দৌলত সবই থাকে। কিন্তু মনে সুখ থাকে না, সংসারে শান্তি থাকে না, সুখ চাইলে আয় সৎপথে হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তারাই সুখী মানুষ, যারা আল্লাহকে খুশি করে, যা আছে তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।
তার জন্য সৎভাবে চেষ্টা করে। মুমিন কখনো হা-হুতাশ করে না। সে জানে, না থাকাটাও তার জন্য কল্যাণকর। জীবন ও প্রাপ্ত নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করে, আরও নেয়ামতে সমৃদ্ধ জীবন কাটায়। পরকালেও অফুরন্ত নেয়ামত লাভের আশা রাখে।
Leave a Reply