দিশারী ডেস্ক। ২৯ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।
২০১১ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুককে সংসদ ভবনের সামনে বেদম মারধরের পর টানা দুই বছর পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে দেয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)।
২০১১ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুককে সংসদ ভবনের সামনে বেদম মারধরের পর টানা দুই বছর পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে দেয়া হয় বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখার পুরস্কার হিসেবে ২০১৬ সালে তাকে দেয়া হয় রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম)। পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষায় নিজেকে এক প্রকার উৎসর্গ করেছেন।
শুধু হারুনই নন, মনিরুল ইসলাম, বিপ্লব কুমার সাহা, প্রলয় জোয়ার্দারের মতো পুলিশ কর্মকর্তারাও একই কাজ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে আকৃষ্ট করতেই দেয়া হতো বিপিএম ও পিপিএম। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর এবারই প্রথম দেয়া হচ্ছে পুলিশ পদক। ৬২ জনকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) দেয়া হচ্ছে। পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন পদক প্রদান কমিটির সভাপতিসহ এক ডজন শীর্ষ কর্মকর্তা। যা নিয়ে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। পদক সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি কমিটিতে থাকা ব্যক্তিদের পদকের জন্য মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে পুলিশ বাহিনীর যেসব সদস্য জীবন বাজি রেখে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে দুজনকে ‘বীর’ উল্লেখ করে বিপিএম দেয়া হয়। এ দুজন হচ্ছেন তৎকালীন র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক জিয়াউল আহসান ও সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জান্নাতুল হাসান।
এছাড়া ওই বছরে বিপিএম-সেবা পদক পান তৎকালীন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (সিআইডি) মো. মোখলেসুর রহমান, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (দক্ষিণ) উপপুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (সদর দপ্তর) হাবিবুর রহমান ও সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ।
————————————————————————————————————————-
পুলিশ পদক পাওয়া এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরে রাজনৈতিকভাবে স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, বিএনপি নেতাকর্মীদের গুমসহ নানা ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত হয়ে তৎকালীন সরকারের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা ব্যক্তিকে গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে জিয়াউল আহসানের।
————————————————————————————————————————-
এছাড়া আয়নাঘর, ফোনকলে আড়িপাতা, মানুষের ব্যক্তিগত আলাপ রেকর্ড ছাড়াও হেফাজতের ঘটনায় যৌথ অভিযানে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই বছরের শেষে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাবেদ পাটোয়ারী আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করতে পুলিশকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করেন। একই কাজ করেন মনিরুল ইসলাম, বেনজীর আহমেদসহ পুলিশ পদক পাওয়া অন্য কর্মকর্তারাও।
এবারো পুলিশের পদক দেয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে বাহিনীর ভেতর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পুলিশ সদস্য বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৯৫২ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মাত্র দুজন পুলিশপ্রধান পুলিশ পদক নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর মাত্র ১৫ বছরে অন্তত পাঁচজন পুলিশপ্রধান এ পুলিশ পদক গ্রহণ করেছেন।
তারা পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছেন।’ এর মধ্যে হাসান মাহমুদ খন্দকার, এ কে এম শহীদুল হক, মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ পদক পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরও পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় পদক প্রদান কমিটির সভাপতিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাম থাকা খুবই হতাশাজনক।
ছাত্র-জনতা গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ ও র্যাবের হয়ে দায়িত্ব পালন করা ১০৩ কর্মকর্তার পদক প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার পাশাপাশি একসময় র্যাবে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন কর্মকর্তার নামও রয়েছে এ তালিকায়।
————————————————————————————————————————-
তাদের পদক বাতিল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ১০৩ জন কর্মকর্তার অনুকূলে প্রদানকৃত বাংলাদেশ পুলিশ পদক ২০১৮-এর বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম-সেবা), রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম), রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম-সেবা) নির্দেশক্রমে প্রত্যাহার করা হলো।
————————————————————————————————————————-
এদিকে আজ থেকে শুরু হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ। চলবে পরবর্তী তিনদিন। ‘আমার পুলিশ আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ এই প্রতিপাদ্যে শুরু হওয়া এই পুলিশ সপ্তাহে ৬২ জনকে বিপিএম ও পিপিএম পদক দেয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছেন পুলিশের সদ্য সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম, র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান, পদক প্রদান কমিটির সভাপতি অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্বে) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, কমিটির আরেক সদস্য পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-প্রশাসন) কাজী মো. ফজলুল করিম।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দায়িত্ব পালন করা ২৪ জন আইজিপি কোনো প্রকার পুলিশ পদক নেননি। ২৫তম আইজিপি হিসেবে হাসান মাহমুদ খন্দকার থেকে শুরু করে পরবর্তী দায়িত্ব পালন করা সকল আইজিপিরই পদক রয়েছে। পদক ছাড়া দায়িত্ব পালন করা সর্বশেষ আইজিপি ছিলেন নুর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারের আমলে আমরা লক্ষ করেছি যে পদক দেয়ার সময় এলেই মন্ত্রীদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। সবাই চেষ্টা করেন পদক তালিকায় তাদের নাম ঢুকাতে। অথচ এই পদকগুলো যারা ভালো কাজ করেছে তাদের উৎসাহিত করা জন্য। বিশেষ করে যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন, তারাই এটার প্রকৃত দাবিদার। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি এসি রুমে কাজ করা কর্মকর্তারা এ ধরনের পদক তিন-চারটা করে নিয়ে থাকেন।
পরবর্তীতে তারা এই পদকের প্রতিদান হিসেবে নানা ভাবে পারপাস সার্ভ করার চেষ্টা করেন। এটা কখনোই উচিত না। তবে এখন যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার। এখানে নিশ্চয়ই এ ধরনের দৌঁড়ঝাপ বা তদবির করে পদক নেয়ার সুযোগ থাকবে না। তাদের উচিত সবার কাছে জেনে শুনে বুঝে পুলিশ পদক দেয়া। আর যারা এই পদক পাবেন তাদের কাছ শেষে সর্বোচ্চ সেবাটা আমরা প্রত্যাশা করি।’
এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক না করে কার্যকর করতে চান বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. বাহারুল আলম। ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পুলিশ সপ্তাহসংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশপ্রধান বলেন, ‘ এবারের পুলিশ সপ্তাহ আনুষ্ঠানিক না করে কার্যকর করতে চাই। এবার পুলিশ সপ্তাহ অনাড়ম্বরভাবে করছি। যেখানে উৎসব-আনন্দ একদমই থাকছে না। পুলিশ সপ্তাহ আমরা আনুষ্ঠানিক না করে কার্যকর করতে চাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ আনন্দ-উৎসব বাদ দিয়ে অনেক বেশি এবার অনেক বেশি কার্যকর সেশনগুলো করা, পেশাগত বিষয়াদি আলোচনা ও বিগত দিনের কর্মকাণ্ড খুঁজে বের করার বিষয়গুলো নিয়ে এই তিনদিন আমরা ব্যস্ত থাকব। সারাদেশের পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপাররা আসবেন। সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থাকবেন। আগামী দিনে কীভাবে আরো উন্নত পুলিশি সেবা নিশ্চিত করতে পারি। সামনে যেসব চ্যালেঞ্জগুলো আসবে সেগুলো থেকে কীভাবে নিজেদের উত্তরণ করব, এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে। মাঠ পর্যায়ে বর্তমান পরিস্থিতি সবার কাছ থেকে নিব, জানব এবং আগামী দিনে তারা কী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সেটা শুনব।’
পুলিশ পদক পুলিশ সদস্যদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করেছে বলে মনে করেন গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সদস্য নূর খান লিটন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা বিগত দিনে দেখেছি যে যারা পুলিশ পদক পেয়েছেন তারা তৎকালীন সরকারের পারপাস বা রাজনৈতিক পারপাস সার্ভ করেছেন। এ ধারাবাহিকতা থেকে এবার বেরিয়ে আসবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’