দিশারী ডেস্ক। ১ মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।
বাংলাদেশের অন্তত ২২টি খাত তাদের কর্মীদের মৌলিক মানবিক চাহিদা মেটাতে যা প্রয়োজন তার থেকে অনেক কম বেতন দিচ্ছে। শ্রম সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, দেশের ২২টি খাতে শ্রমিকদের মজুরি এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে।
প্রতিবেদন অনুসারে, যদি কেউ মাসে সাত হাজার ৮৬৯ টাকার কম আয় করেন, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন। শ্রমিক নেতারা বলেন, এর অর্থ হচ্ছে ওই শ্রমিকরা দৈনন্দিন চাহিদাও মেটাতে পারেন না।
কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা এই বিষয়টি নিরূপণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এটি বিশ্বব্যাংকের দৈনিক দুই দশমিক ১৫ ডলার আয়ের বেঞ্চমার্কের ওপর ভিত্তি করে এবং ২০১৭ সালের ক্রয়ক্ষমতা সমতা সূচক ব্যবহারের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়েছে।
ক্রয়ক্ষমতা সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি, যা পিপিপি নামে সমধিক পরিচিত, আন্ত:দেশীয় মুদ্রার প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপের একটি জনপ্রিয় সূচক। এটি একটি তত্ত্বীয় পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দুটি ভিন্ন মুদ্রার দীর্ঘমেয়াদে বিনিময় হারের সাহায্যে তাদের ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপ করা হয়।
শ্রম আইন-২০০৬ এর অধীনে পরিচালিত সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বাংলাদেশ ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বেসরকারি খাতের মজুরি নির্ধারণ করে। এটি ৪৭টি খাতের মজুরি হার পর্যালোচনা ও সুপারিশ করে। শ্রম সংস্কার কমিশন এরমধ্যে ৩৯টি খাত পর্যালোচনা করে দেখেছে যে, অর্ধেকেরও বেশি খাতে ন্যূনতম মজুরি হার দারিদ্র্যসীমার নিচে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আরও বলেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রম করেন, তারপরও সন্তানদের জন্য সঠিক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একপর্যায়ে তাদের উত্পাদনশীলতা হ্রাস পায় এবং কর্মক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে।’
—————————————————————————————————————————-
সরকারিভাবে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি সাত হাজার ৮৬৯ টাকার নিচে থাকা ২২টি খাতের মধ্যে রয়েছে টাইপ ফাউন্ড্রি (৫২১ টাকা), পেট্রোল পাম্প (৭৯২ টাকা), ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠান (তিন হাজার টাকা), হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট (তিন হাজার ৭১০ টাকা), আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ (চার হাজার ২৪০ টাকা), আয়ুর্বেদিক কারখানা (চার হাজার ৩৫০ টাকা), ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ (চার হাজার ৫৬০ টাকা), জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং (চার হাজার ৮৫০ টাকা), দর্জি কারখানা (চার হাজার ৮৫০ টাকা), কটন টেক্সটাইল (পাঁচ হাজার ৭১০ টাকা) ও বেকারি, বিস্কুট এবং কনফেকশনারী (পাঁচ হাজার ৯৪০ টাকা)।
—————————————————————————————————————————-
অপরদিকে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে মজুরি দিচ্ছে এমন খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস (আট হাজার ৫০ টাকা), ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল এবং প্লাস্টিক শিল্প (আট হাজার টাকা), প্রিন্টিং প্রেস (আট হাজার ১৫০ টাকা), গ্লাস অ্যান্ড সিলিকেট (সাড়ে আট হাজার টাকা), অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল (আট হাজার ৭০০ টাকা), সিকিউরিটি সার্ভিস (নয় হাজার ১৪০ টাকা), মৎস্য শিকারী ট্রলার ইন্ডাস্ট্রিজ (১০ হাজার ৫২০ টাকা), ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন (১০ হাজার ১০০ টাকা), রি-রোলিং মিল (১০ হাজার ৬৫০ টাকা), হোমিওপ্যাথ কারখানা (সাড়ে ১১ হাজার টাকা), গার্মেন্টস (সাড়ে ১২ হাজার টাকা), ট্যানারি (১২ হাজার ৮০০ টাকা) এবং স-মিল (১৭ হাজার ৯০০ টাকা)।
আইন অনুযায়ী, এই ন্যূনতম মজুরি প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংশোধন করতে হয়। তবে শ্রমিক নেতারা বলছেন যে, বোর্ড কমপক্ষে ১৮টি খাতে মজুরি সংশোধন করতে ব্যর্থ হয়েছে, কিছু খাত ৪২ বছর ধরে অস্পৃশ্য রয়ে গেছে।
—————————————————————————————————————————-
টাইপ ফাউন্ড্রি শ্রমিকদের মজুরি সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে সংশোধন হয়েছিল। পেট্রোল পাম্প শ্রমিকদের মজুরি ১৯৮৭ সালের পর আর সংশোধন করা হয়নি। আয়ুর্বেদিক কারখানা শ্রমিকদের মজুরি সর্বশেষ ২০০৯ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। আয়রন ফাউন্ড্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস শ্রমিকদের মজুরি সর্বশেষ ২০১০ সালে, সল্ট ক্রাশিং শ্রমিকদের মজুরি ২০১১ সালে, ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোর শ্রমিকদের মজুরি ২০১২ সালে, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ শ্রমিকদের মজুরি ২০১৩ সালে, জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং শ্রমিকদের মজুরি ২০১৪ সালে এবং হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট শ্রমিকদের মজুরি ২০১৬ সালে নির্ধারণ হয়েছিল।
—————————————————————————————————————————-
বাংলাদেশ হোটেল, রেস্তোরাঁ, সুইটমিট ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন শ্রমিকদের সংগ্রামের কথা তুলে ধরে বলেন, তারা দিনে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা কাজ করলেও সামান্য মজুরি পান।
আমাদের মজুরি এমনভাবে দেয়া হয়, যাতে কোনোমতে সংসার চলে এবং পরদিন কাজে যেতে পারি। মাত্র তিন-চার হাজার টাকায় কীভাবে একটি পরিবার চলে ? ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া ও চিকিৎসার খরচ মেটানো খুবই কঠিন , বলেন তিনি।
তিনি ন্যূনতম ন্যায্য মজুরি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে নির্ধারণের ওপর জোর দেন। বলেন, যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দিন দিন বাড়ছে, এর চেয়ে কম টাকায় চলা সম্ভব না।
গত ২১ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন। তারা একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে, যেটি খাত বা কাজের ধরন নির্বিশেষে সকল শ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য হবে।
প্রস্তাবটির লক্ষ্য আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক উভয় ক্ষেত্রেই, সরকারি ও বেসরকারি চাকরি, বিদেশি সংস্থা এবং এমনকি স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য একক মজুরি ব্যবস্থা তৈরি করা। কমিশন আরও প্রস্তাব করেছে যে, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর জাতীয় এবং খাতভিত্তিক মজুরি ব্যবস্থা সংশোধন করতে হবে।
প্রতিবেদনে যোগ করা হয়েছে যে, নির্দিষ্ট খাত ও পেশাদারদের ন্যূনতম মজুরি কখনই জাতীয় ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম হওয়া উচিত নয় এবং এর পরিবর্তে সমান বা বেশি হওয়া উচিত।
অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দারিদ্র্যসীমার নিচে মজুরি অযৌক্তিক। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সময় এটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ যে, কোনো শ্রমিকের আয় যেন দারিদ্র্যসীমার নিচে না পড়ে, বলেন তিনি।
তিনি জোর দেন যে, একজন শ্রমিকের কমপক্ষে চারজনের একটি পরিবারকে চালানোর জন্য এবং তাদের মৌলিক মাসিক চাহিদা মেটাতে যা প্রয়োজন তার ওপর ভিত্তি করে মজুরি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সর্বনিম্ন মজুরি কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের ওপর কম বেতনের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এটি তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবারের ওপর প্রভাব ফেলে। যদি তাদের প্রজনন প্রভাবিত হয়, তবে তা স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। যে নারীরা কঠোর পরিশ্রম করেন এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দুর্বল হতে পারে। যখন শ্রমিকদের উত্পাদনশীলতা হ্রাস পায়, তখন জাতীয় উৎপাদনশীলতাও হ্রাস পায়, যার ফলে জাতিরও ক্ষতি হয়’
ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ও শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ফার্মাসিউটিক্যালস, জাহাজ ভাঙা, রং ও ক্যামিকেল কারখানা, বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারী, ব্যাটারি প্রস্তুতকারক এবং অটোমোবাইলসহ বেশ কয়েকটি খাতে শ্রমিকদের মজুরি সংশোধনের কাজ চলছে। পোল্ট্রি ও টি প্যাকেজিং খাতে ন্যূনতম মজুরির জন্য একটি খসড়া গেজেটও জারি করেছে বোর্ড।
সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন উল্লেখ করেছেন যে, সাধারণত খসড়া গেজেট সম্পর্কে মতামত দেওয়ার জন্য অংশীজনদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে কিছু খাত এখনো বোর্ড কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত মজুরি বাস্তবায়নে ব্যর্থ।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি (শ্রম সংস্কার কমিশনের) রিপোর্ট পর্যালোচনার পর আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।