১০ লাখ ৬৮ হাজার শিশুই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
  • 39 পাঠক

দিশারী ডেস্ক ।২ মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম পুরোপুরি দুর করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও দেশে শিশুশ্রম কমেছে না। উল্টো পরিসংখ্যান বলছে বিভিন্ন কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়ছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা যায়, দেশে পাঁচ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। এদের মধ্যে ১০ লাখ ৬৮ হাজার শিশুই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত। ঝুঁকি নেই এমন কাজে যুক্ত আছে ৭ লাখ ৭ হাজার শিশু। অথচ, ২০১৩ সালে বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট শিশুশ্রমিক ছিল ১৬ লাখ ৯৮ হাজার। দশ বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়েছে ৭৭ হাজার।

বিবিএসের করা ‘সেক্টরভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিশুশ্রম জরিপ’ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, লিঙ্গ নির্বিশেষে শ্রমজীবী শিশুদের সিংহভাগই মা-বাবার সঙ্গে একত্রে বসবাস করছে। তবুও শ্রমজীবী শিশুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পড়াশোনার সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

জরিপে পাওয়া তথ্যানুযায়ী শ্রমজীবী শিশুদের প্রায় ১৬ শতাংশ পড়তে এবং লিখতে পারে না। এর মধ্যে মেয়ে শিশুদের (০.৩ শতাংশ) তুলনায় ছেলে শিশুদের একটি বৃহত্তর শতাংশ রয়েছে যারা শুধু পড়তে পারলেও, লিখতে পারে না (৭.৬ শতাংশ)। বিপরীতভাবে, ছেলেদের (০.২ শতাংশ) তুলনায় মেয়েদের (৩.৭ শতাংশ) মধ্যে লেখার দক্ষতা বেশি পরিলক্ষিত হয়।

পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ সেক্টরের কাজ করা শিশুদের ওপর বিবিএসের করা জরিপে ওঠে আসে, পল্লি এবং শহর উভয়ক্ষেত্রেই মা-বাবা বেঁচে আছে এমন পরিবার থেকে আসা শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৯০.৬ শতাংশ। পল্লি এলাকায় এই সংখ্যাটি ৮৯.৩ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৯১.৩ শতাংশ, যা কি না শহরাঞ্চলে একটু বেশি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বস্তি এলাকায় বাস করে।

তথ্যানুযায়ী মোট শ্রমজীবী শিশুর ২০.৩ শতাংশ তাদের মাতাপিতার সঙ্গে বস্তি এলাকায় বাস করে। বেশির ভাগ শ্রমজীবী শিশু অর্থাৎ মোট শ্রমজীবী শিশুর ৬৯.৪ শতাংশ তাদের মাতাপিতার সঙ্গে রাত্রিযাপন করে।

পরিসংখ্যান দ্বারা আরও বিশদভাবে বর্ণনা করা যায় যে, ৬৯.৯ শতাংশ ছেলে এবং ৫১.৪ শতাংশ মেয়ে শ্রমজীবী শিশু তাদের মাতাপিতার সঙ্গে বাড়িতে ঘুমায়। এদের মধ্যে ৫-১১ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুরা অনেকেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার সুযোগ পেলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উচ্চতর শ্রেণিতে শিক্ষা গ্রহণের প্রবণতা কমতে থাকে।

জরিপে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১২-১৩ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুদের ৭২.২ শতাংশ রয়েছে যার ১ম-৫ম গ্রেড সম্পন্ন করছে। সেখানে মাত্র ২৭.৮ শতাংশ শিশু রয়েছে যারা ষষ্ঠ-দশম গ্রেডের দিকে উন্নীত হচ্ছে। একইভাবে ১৪-১৭ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয় যে, ৫৯.৩ শতাংশ শিশু যারা ১ম থেকে ৫ম গ্রেড সম্পন্ন করেছে এবং ৩৫.২ শতাংশ শ্রমজীবী শিশু ষষ্ঠ-দশম গ্রেড সম্পন্ন করেছে।

শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘শিশুদের জন্য’ প্রকল্পের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ওমর ফারুক বলেন, শ্রমজীবী শিশুদের স্কুলে না যাওয়ার পেছনে প্রধান যে কারণগুলো আছে তার মধ্যে প্রথমত, এই শিশুদের মা-বাবা উভই কর্মজীবী হয়ে থাকেন। সারা দিন তাদের ঘরের বাইরে থাকতে হয়।

শিশুদের স্কুলে দিলে তারা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্কুলে থাকবে ঠিকই, কিন্তু স্কুল শেষ হলে তাদের বাসায় দেখাশোনা করার মতো কেউ থাকবে না। তাই বেশির ভাগ মা-বাবা শিশুদের নিজেদের কর্মস্থানে বা কর্মস্থানের আশেপাশে কোনো গ্যারাজ বা কারখানায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজে দিয়ে দেয়। এতে তাদের জন্য কোনো চিন্তাও থাকে না, আর শিশু বয়স থেকে কাজে যাওয়ার ফলে তাদের কাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতাও অল্প বয়সে হয়। এটাকে এক ধরনের বিনিয়োগও মনে করেন শিশুদের মা-বাবা।

দ্বিতীয়ত, এই শিশুদের কোনো প্রি-স্কুলিং অভিজ্ঞতা থাকে না। এর ফলে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করালেও নতুন পরিবেশ, স্কুলের নিয়ম-কানুন বিভিন্ন কিছুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না তারা। যার ফলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বসের অভাব হয়, পড়াশোনার প্রতি ভীতি জন্মায়।

বিবিএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শ্রমজীবী শিশুদের একটা বড় অংশ রয়েছে, যারা শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে না পারার কারণেই বর্তমানে স্কুলে অধ্যয়ন করছে না। তথ্যানুযায়ী, ছেলে এবং মেয়ে উভয়ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী শিশুদের ৫২.৮ শতাংশ আর্থিকসংকটের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের গুটিয়ে নেয়।

আবার অনেক ক্ষেত্রে শ্রমজীবী শিশুরা নিজের ইচ্ছাতেই স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। ছেলে শ্রমজীবী শিশুরা স্কুলে যাওয়ার চাইতে কর্মে সম্পৃক্ত থাকতেই বেশি আগ্রহী হয় (১১.৩ শতাংশ) যা কি না মেয়ে শ্রমজীবী শিশুদের ক্ষেত্রে ২৪.৪ শতাংশ। মূলত নিজস্ব ইচ্ছার অভাবেই শ্রমজীবী শিশুরা স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকে, যা কি না ৩১.৬ শতাংশ এবং ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি একটু বেশি যা ৩১.৩৮ শতাংশ।

এ বিষয়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পথশিশু সেবা সংগঠনের কো-অর্ডিনেটর কাওসার আহমেদ নিলয় বলেন, শিশুশ্রমিক অধিকাংশই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী নয়। এর মূল কারণ, ছোট বয়সে অর্থ উপার্জন শুরু করার ফলে পড়াশোনার করার প্রতি তাদের কোনো স্পৃহা থাকে না। যেহেতু আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষই পড়াশোনা করাকে অর্থ উপার্জনের সোপান মনে করেন, তাই এই বয়সে তারা যখন এরই মধ্যে অর্থ উপার্জন করা শুরু করে দিয়েছে, পড়াশোনা করাকে আর তাদের গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না।

এ ছাড়াও আরেকটি প্রধান কারণ, শ্রমজীবী শিশুদের মা-বাবাও তাদের পড়াশোনা করানোর ব্যাপারে উদাসীন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!