মুফতি ইবরাহিম সুলতান । ১০ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
সম্প্রতি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে দেশব্যাপী তুমুল সমালোচনা চলছে। এ ছাড়া পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের অসাধু উপায় অবলম্বনের সচিত্র খবর ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের পক্ষ থেকে বলে-কয়ে উত্তর লেখার দুর্নীতি তো প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলে যোগ্য শিক্ষার্থীরা তাঁদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারছেন না।
আর এ সুযোগে কর্মক্ষেত্রে অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিবাজদের পদায়ন করা হচ্ছে। ফলে জাতির ভবিষ্যৎ চরম অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তা ছাড়া এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অযোগ্যদের সুযোগ করে দেওয়া এটি কিয়ামতেরও একটি আলামত। এক বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন অযোগ্য, অদক্ষ ব্যক্তিদের কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তখন তোমরা কিয়ামতের প্রতীক্ষায় থেকো। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫৯)
আর এটি স্পষ্ট বিষয় যে প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে অনেক বড় আমানত। যারা সামান্য মূল্যের বিনিময়ে এটি ফাঁস করে, তারা মূলত শিক্ষার্থীদের মেধা ও আমানতের খিয়ানত করে। তাদের শাস্তির ব্যাপারে হাদিস শরিফে কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারিতা নেই তার ঈমান নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৩৮৩)
পৃথিবীতে ঈমানই মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। যখন ঈমানই থাকবে না তখন তার জীবনেরও সার্থকতা থাকবে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, আল্লাহ ও রাসুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কোরো না এবং জেনে-শুনে নিজেদের আমানতের খিয়ানত কোরো না। (সুরা আনফাল, আয়াত : ২৭)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, আয়াতের প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, ‘খিয়ানত’ এখানে ব্যাপকার্থে। ছোট-বড়, সংক্রামক ও অসংক্রামক, সব অপরাধই এখানে অন্তর্ভুক্ত।(তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৪১)
তা ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস করা সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও শরয়ি অপরাধ। যারা এ জঘন্য কাজের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তো আমি তাদের আমার রহমত থেকে বিতাড়িত করি ও তাদের অন্তর কঠিন করে দিই।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১৩)
আবার অনেক সময় দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দুর্নীতিকারীদের দুর্নীতি ঢাকার চেষ্টা করে এবং ইনিয়েবিনিয়ে তাদের পক্ষে থাকার চেষ্টা করে। এতে দুর্বৃত্তরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের এ ঘৃণিত কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আপনি খিয়ানতকারীদের পক্ষাবলম্বনকারী হবেন না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১০৫)
মোটকথা, অযোগ্যে, দুর্নীতিবাজ ও খিয়ানতকারীদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া অনেক বড় অপরাধ। নবীজি (সা.) এটিকে কিয়ামতের আলামতও বলেছেন। সাহাবি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন রাসুল (সা.) সবাইকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন এক গ্রাম্যলোক এসে প্রশ্ন করল, কিয়ামত কবে? নবীজি (সা.) তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। এতে উপস্থিত অনেকের ধারণা হয়েছিল, নবীজি (সা.) তার প্রশ্ন শুনেও জবাব দেননি। কারণ তিনি অপছন্দ করেছেন।
আবার কারো কারো মনে হয়েছিল, নবীজি (সা.) সম্ভবত তার কথা শুনতেই পাননি। আলোচনা শেষ হওয়ার পর রাসুল (সা.) খোঁজ করলেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী কোথায়? লোকটি বলল, এই যে আমি। তখন নবীজি (সা.) বললেন, আমানত যখন নষ্ট হওয়া শুরু হবে তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা করো। লোকটি বলল, আমানত আবার নষ্ট হয় কিভাবে? রাসুল (সা.) তখন বললেন, অযোগ্য ব্যক্তির কাছে যখন দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হবে তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা কোরো। (বুখারি : ৫৯)
প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আমাদের দ্বিতীয় করণীয় হলো, যার যার জায়গা থেকে শালীন ও শান্তি-শৃঙ্খলার সঙ্গে প্রতিবাদ গড়ে তোলা। এই মর্মে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় (পাপাচার, দুর্নীতি) হতে দেখে, সে যেন সম্ভব হলে তা হাত দ্বারা রুখে দেয়। আর এটা সম্ভব না হলে প্রতিবাদী ভাষা দিয়ে তা প্রতিহত করে। আর তা-ও না পারলে সে যেন ওই অপকর্মকে হৃদয় দ্বারা বন্ধ করার পরিকল্পনা করে (মনে মনে ঘৃণা করে), এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৭২)
মহান আল্লাহ প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ মহামারি থেকে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ প্রিয় শিক্ষার্থীদের রক্ষা করুন।
Leave a Reply