ছয় বছরে ৪৩ হাজার নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, মার্চ ১১, ২০২৫
  • 5 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ১১ মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।

পতিত স্বৈরাচার সরকারের সময়ে ছাত্রাবাস থেকে শুরু করে রাজপথে কোথাও বাকি ছিল না ধর্ষণের মচ্ছব। শেষ ছয় বছরেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ হাজার শিশুসহ প্রায় ৪৩ হাজারের বেশি নারী। এই সময়ে নির্যাতন শিকার হয়েছেন ১ লাখ ৩৭ হাজার নারী। অপহরণের শিকার হয়েছেন ২৮ হাজার ৪৮ নারী ও শিশু।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী দ্বারা নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু নারীবাদী নেত্রী এবং মহিলা পরিষদসহ এমন ঘৃণ্য ঘটনায় প্রতিবাদ দূরের কথা, বিভিন্ন সংগঠনের উদ্বেগ ধামাচাপা দিয়েছে বছরের পর বছর। তাদের এমন নীরবতায় হাইকোর্ট ডিভিশন পর্যন্ত শাসিয়েছেন।

জুলাই গণবিপ্লবের সময়ে আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন নিয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারি বাহিনী এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণে বাধা দিতে যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় নারী আন্দোলনকারীদের বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়।

পুলিশের তথ্যে ধর্ষণের সংখ্যা

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, গত পাঁচ বছরে দেশে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ছিল উদ্বেগজনক। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারাদেশে তিন মাসে ধর্ষণের ঘটনায় ৩৪ হাজার ৪৭০টি মামলা করা হয়েছে। এ সময় থানায় করা মামলার মধ্যে পুলিশ ৬ হাজার ১০০ ধর্ষণের মামলা তদন্ত শেষে ৯ হাজার ২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে। আরো অনেক মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াধীন আছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, শুধু ২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণের ঘটনায় থানায় ৬ হাজার ১১৪টি মামলা করা হয়েছে। ২০২০ সালে ৭ হাজার ১৯৪টি, ২০২১ সালে ৬ হাজার ৯৮৬টি, ২০২২ সালে ৭ হাজার ১২টি, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ২৩২টি এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৩০৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৫১টি ও মার্চ মাসে ৩৭৩টি মামলা করা হয়েছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (বিগত ৬ বছরে) ৪৩ হাজার ৪৭২টি ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এ সময় নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৫৭১টি। যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। শুধু ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের অভিযোগ আসে ৪ হাজার ৩৩১টি, নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৬৯টি। এ সময়ে যৌতুক না পেয়ে ও ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১৫৯ জন নারী। থানায় ‘পুলিশ শূন্য সময়’ আগস্টে সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে।

পুলিশের সঙ্গে মহিলা পরিষদের তথ্যে বিস্তর পার্থক্য

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় থানাগুলোতে ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৭৬৪টি মামলা হয়েছে, ২০২০ সালে হয়েছে ২২ হাজার ৫১৭টি, ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬টি, ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬টি এবং ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১টি মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালে জুলাই বিপ্লবের কারণে থানাগুলোতে পুলিশের অনুপস্থিতির ফলে কিছু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়নি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে ১ হাজার ৭ জন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৭৮৪ জন নারী, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৭০৩ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২০২২ সালে ৯৮৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে পরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৩৮ জন। ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৯৩৭টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৩৯ জন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় লিগ্যাল অ্যাইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।

গত বছরের পরিসংখ্যানে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় থানাগুলোতে সবচেয়ে কম মামলা হয়েছে আগস্টে। অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে ১৩ থেকে ৪৭ শতাংশ মামলা কম হয়েছে। জানুয়ারিতে ৭৮৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ৯৯৩টি, মার্চে ১ হাজার ১০০টি, এপ্রিলে ১ হাজার ২৩৬টি, মে মাসে ১ হাজার ২৯০টি, জুনে ১ হাজার ১৯১টি, জুলাইয়ে ১ হাজার ২৪০টি, আগস্টে ৬৮৪ ও সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ৭১টি মামলা হয়। এর বাইরে আদালতে থেকে পাওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে থানায় মামলা হয় ৩ হাজার ১৭৮টি।

গত ছয় বছরে নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত অন্য অপরাধের মধ্যে ১ হাজার ১৫২ জন নারী ও শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং অ্যাসিড নিক্ষেপেরে ঘটনা ঘটেছে ১৭৯ জন নারী ও শিশুর ওপর।

ছাত্রলীগের হাতে ধর্ষণ

গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বহিরাগত এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্তরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও বহিরাগত যুবক মামুন (৪৫)। তাদের মধ্যে মোস্তাফিজ মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক।

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে তার সম্মুখেই স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর নৃশংস এ ঘটনায় জড়িত ছিল ছাত্রলীগের সক্রিয় ছয় কর্মী। ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর এ ঘটনা ঘটে। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় হাইকোর্ট নারী নেত্রীদের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

যা বলছে পুলিশ

দেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ কেন বাড়ছে এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়া ইনামুল হক সাগর বলেন, কখনো কখনো অপরাধ বাড়ে, তবে এই মুহূর্তে হঠাৎ ধর্ষণের ঘটনা বাড়ার পেছনে বিশেষ উদ্দেশ্য কাজ করছে কি না, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অস্থিতিশীলতা তৈরিতে এসব চলছে- তদন্তে এমন বিষয় পেলে অবশ্যই এর মূলোৎপাটন করব।

তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে, আরো জড়িত যারা গ্রেপ্তার হয়নি তাদেরও খুব শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে। তবে পুলিশ চার্জশিট দেয়ার পর অপরাধীরা যথাসময়ে যথাযোগ্য শাস্তি পেলে অন্য অপরাধীরা সচেতন হবে, অপরাধ কমে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে সামাজিক বন্ধন দুর্বল হলে মানুষ এসব অপরাধে যুক্ত হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বর্তমান সরকারের অবস্থান

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন। রোববার আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান তিনি। উপদেষ্টা বলেন, মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তদন্ত শেষ করতে হবে।

পুলিশ হেডকোয়ার্টারে হটলাইন চালু

নারী নির্যাতন, নারীর প্রতি আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, কটূক্তি, ইভটিজিং, হেনস্তা, যৌন হয়রানি বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স হটলাইন সেবা চালু করেছে। দেশের যে কোনো স্থানে এরূপ ঘটনা ঘটলে এই হটলাইনে অভিযোগ দেওয়া যাবে বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে পুলিশ সদর। এআইজি মিডিয়া ইনামুল হক সাগর জানান, তিনটি নম্বর ২৪ ঘণ্টা চালু থাকবে। হটলাইন নম্বরগুলো হলো – ০১৩২০০০২০০১, ০১৩২০০০২০০২, ০১৩২০০০২২২২।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!