নিজস্ব প্রতিনিধি
————-
স্বল্প পুঁজিতে অল্প সময়ে কোটিপতি অনেকে। তাদের দেখে অন্যরাও পা বাড়চ্ছেন এ পথে। অভিযোগ রয়েছে, থানা পুলিশের সাথে অনেক কারবারীর রয়েছে দহরম সম্পর্ক। রয়েছে মাসোয়ারা আদায়ের গোপণ চুক্তিও। অবশ্য, এমন কথা উড়িয়ে দেন জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা। বলেন, কারো বিষয়ে সঠিক প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইয়াবা কারবারিদের হাতে আছে ‘আলাদিনের চেরাগ।’ যারাই ১-২ বছর ইয়াবার পাইকারি কারবার চালাতে পেরেছেন তারাই বনে গেছেন বিত্তশালী।
পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট বা সিআইডি) কর্মকর্তারা বলেছেন, ইয়াবা কারবার করে রাতারাতি অর্থ-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ির মালিক বনে গেছেন অনেকেই। এরপর টাকার জোরে ক্ষমতা, প্রভাব, প্রশাসনিক দাপট, রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে শুরু করে এলাকায় আলাদা সাম্রাজ্যও গড়ে তুলছেন তারা। ইয়াবার পাইকারি কারবারিদের অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় জনপ্রতিনিধির চেয়ারেও বসেছেন। আবার অনেকে নিজেকে সমাজপতি করার দাবিতে পোষ্টার ছেড়েছেন। ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে স্বল্প সময়ে কোটিপতি হয়ে ওঠার অপ্রতিরোধ্য দৌরাত্ম্য চলছে নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে।
সমাজসচেতনরা বলেন, যে কোনো উপায়ে ইয়াবা কারবারিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ বাস্তবতা অপেক্ষা করছে। এর মাশুল দিতে হবে সবাইকে। ইয়াবার বিস্তার ঠেকাতে সমন্বয়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারে জোর দেন তারা।
পুলিশ ও র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া ইয়াবা কারবারিদের নাম-ঠিকানা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে- রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে গাড়ি চালক, হেলপার, দিনমজুর, মুদি দোকানি, বেকার-বখাটে, দেহ ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ইয়াবা কারবারের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। রাতারাতি বিত্তশালী হওয়ার নেশায় এ কারবারের ব্যপ্তি বাড়ছে। ইয়াবা কারবারের অনেক গডফাদারের সম্পদ ও অর্থবিত্ত কল্পকাহিনীকেও হার মানায়।
ইয়াবা কারবারিদের ধনসম্পদ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মাত্র ক’বছর আগেও এলাকায় অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী দিনমজুরি করতেন। তাদের কিন্তু এখন তাদের ব্যাংক হিসাবে টাকার ছড়াছড়ি। জায়গা, জমি, বাড়ি, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই।
সরেজমিন দেখা গেছে, অল্প সময়ে বিত্তশালী হওয়া অনেকে প্রত্যন্ত এলাকায় মেঠোপথ ঘেঁষেই তৈরি করেছেন সুরম্য অট্টালিকা। গ্রাম ছাড়িয়ে শহরেও রয়েছে তাদের বাড়ি-গাড়ি।
এ জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ জেলায় বেশ কিছু ইয়াবা ব্যবসায়ীর এ কারবারের জের ধরেই বদলে গেছে গোটা পারিবারিক জীবন। এরা এখন বিপুল ধন-সম্পদের মালিক।
মাদক কারবারিদের কথা স্বীকার করে জেলার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তালিকাভুক্ত অনেকেই কারাগারে আছে। আবার অনেকেই জামিনে বেরিয়ে পুনরায় ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তাদেরও কাউকে কাউকে ফের গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা বড় কারবারি তারা এলাকায় থাকে না। প্রতিদিনই নতুন নতুন মাদক কারবারি তৈরি হচ্ছে, ধরাও পড়ছে। শুধু বিক্রেতা নয়, মাদক কারবারে অর্থ লগ্নিকারী, পৃষ্ঠপোষক, সংরক্ষক, বহনকারী, খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলমান। যাতে জড়িতদের আদালতে সাজা হয় সে ব্যাপারে কঠোরভাবে কাজ করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দেশে ব্যবহৃত মাদক দেশের বাইরে থেকে আসে। সীমান্ত পথে দেশে মাদকের প্রবেশ ঠেকানো পুলিশের আওতাধীন নয়। মাদক দেশে প্রবেশের পর মুহূর্তেই হাজার হাতে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের পক্ষে বিস্তার ও ব্যবহার রোধ সহজ হয় না।
দীর্ঘদিন ধরে মাদকবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার একজন আইনজীবি বলেন, মাদক মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ও ক্ষেত্র বিশেষে বিচারহীনতার কারণে বড় মাদক কারবারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। সাক্ষী পাওয়া যায় না। আলামত নষ্ট করে ফেলেন। মাদক কারবারিদের উদ্ভাবনী কৌশলের কাছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুলিয়ে ওঠতে পারে না। এক্ষেত্রে পুলিশের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন দরকার। একই সঙ্গে ইয়াবা কারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন জামিন না পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে সচেতন করতে হবে যুব সমাজকে। কেন তারা মাদক নেবে। চাহিদা যখন কমবে কারবারিরাও তখন আগ্রহ হারাবে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, অনেকে সরাসরি ইয়াবা কারবার না করে অর্থ লগ্নি করছেন। মাসে দ্বিগুণ লাভে ইয়াবা কারবারিদের দাদন দিয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠছেন তারা। নগদ টাকার যোগান পেয়ে খুদে কারবারিদের অনেকেই এখন ডিলার। মাদকে ‘পুঁজি বিনিয়োগ’র এ কারবার দেশে প্রচলিত এনজিওগুলোর চক্রবৃদ্ধি সুদ, মালটিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিগুলোর স্বপ্ন দেখানো ধাপ্পাবাজিকেও ছাপিয়ে গেছে। পুঁজির দ্বিগুণ লাভ করতে গিয়ে অনেকেই আবার সর্বস্ব হারাচ্ছেন।
দেশের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ইয়াবা কারবারি ও লেনদেনের তথ্যানুসন্ধানে নেমে ‘দাদন ব্যবসা’র চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন। সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, পুঁজির সহজলভ্যতাও মাদক ব্যবসা বিস্তারের একটি বড় কারণ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে সরকারের কাছে।
Leave a Reply