শাহাদাত হোসাইন।০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
মিথ্যা বলা এমন একটি খারাপ স্বভাব, যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সব দুর্নীতি আর দুরাচারকে সামনে আনে। নবীজি মিথ্যা বলাকে যতটা ঘৃণা করতেন অন্য কিছুকে ততটা ঘৃণা করতেন না। তিনি কোনো ব্যক্তির মিথ্যা বলা সম্পর্কে জানতে পারলে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। তবে সে যদি তার মিথ্যার ব্যাপারে তাওবা করত, তাহলেই তিনি স্বাভাবিক হতেন। (শুয়াবুল ঈমান, হাদিস : ৪৪৭৫)।
একজন মুমিন কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। নবীজি (সা.) বলেছেন, একজন মুমিনের ভেতরে অনেক ধরনের ত্রুটিই থাকতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সে মিথ্যুক ও অসৎ হতে পারে না। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ২২১৭০)।
সাফওয়ান ইবনে সুলাইম বলেন, একবার নবীজিকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মুমিন কি ভীতু হতে পারে? নবীজি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। আবার বলা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? নবীজি বলেন, হ্যাঁ।
পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলো, মুমিন কি মিথ্যুক হতে পারে? নবীজি (সা.) বলেন, না। মুমিন কখনো মিথ্যুক হতে পারে না। (তাম্বিহুল গাফিলিন, হাদিস : ১৯৯)।
সন্তান প্রতিপালনে মিথ্যার আশ্রয় নয়
ইসলাম স্বচ্ছ-সফেদ নিষ্কলুষ জীবনব্যবস্থায় বিশ্বাসী। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে শত-শতাংশ সততায় গুরুত্ব আরোপ করে। অঙ্কুরেই সন্তানদের সততার সফেদ চাদরে মুড়িয়ে নেওয়ার দীক্ষা দেয়। সন্তান প্রতিপালনে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্রয় দেয় না।
আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) বলেন, একদিনের ঘটনা। নবীজি আমাদের বাড়িতে ছিলেন। এ অবস্থায় মা আমাকে ডাকলেন এবং বলেন, আসো, তোমাকে একটি জিনিস দেব।
তখন নবীজি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আসলেই কিছু দেবে ? মা বলেন, আমি তাকে খেজুর দেব। এবার নবীজি (সা.) বলেন, যদি তুমি তাকে সেটা না দিতে তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হতো। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯১)।
মিথ্যা ও ধোঁকাপূর্ণ কথায় শিশুর কচি হৃদয়ে রেখাপাত করে এবং মিথ্যা বলাকে স্বাভাবিক মনে করতে থাকে। এর ফলাফল তার ভবিষ্যৎ জীবনে পরস্ফুিটিত হয়।
ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা নয়
রসিকতা কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা আমাদের প্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, রসিকতা কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা বৈধ নয়। (আজ-জুহদ, পৃষ্ঠা ৩৯৫)।
নবীজি (সা.)-এর রসিকতায়ও পূর্ণ সততা থাকত। তিনি সেসব স্থান ও আয়োজন পরিহার করতে বলেছেন, যেখানে মিথ্যার চর্চা হয়। বর্তমান সমাজে কিছু কিছু আয়োজন এমন আছে, যেখানে মিথ্যাকে আর্ট হিসেবে পেশ করা হয়। সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে শ্রুতিমধুর করে মিথ্যাকে পরিবেশন করা হয়। শ্রোতারাও তা নির্দ্বিধায় গলাধঃকরণ করে। এটা অত্যন্ত গর্হিত ও পরিত্যাজ্য বিষয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস, যে মানুষ হাসানোর জন্য (কৌতুক) মিথ্যা বলে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৩১৫)।
মিথ্যা অপবাদ ধ্বংস আনে
অপবাদ আরোপ কোরআনে বর্ণিত এক জঘন্য অপরাধের নাম। অপবাদ সাধারণ মিথ্যার থেকেও জঘন্য। এতে বান্দার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হয়। অরাজকতার সৃষ্টি হয়। মানুষ পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারায়। সম্পর্ক ছিন্ন হয়। অপবাদ প্রদানকারীকে কোরআন অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছে। এর দ্বারা ব্যক্তি অন্যের সম্মানহানির পাশাপাশি নিজেকে কবিরা গুনাহে লিপ্ত করে, যা কোনো ক্ষেত্রেই কল্যাণকর নয়। আমাদের সমাজে অপবাদের নানা ধরন প্রচলিত আছে, যেগুলো প্রতিটি জঘন্য থেকে জঘন্যতর। আমাদের উচিত, সেগুলো থেকে বিরত থাকা।
চারিত্রিক অপবাদ আরোপের শাস্তি দুনিয়াতেই
চারিত্রিক অপবাদ একটি মারাত্মক অপরাধ। এতে ব্যক্তির সম্মানহানি করা হয়। সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। অপবাদ প্রদানকারীরা হয়তো সেটাকে হালকা মনে করে, কিন্তু বিষয়টি আসলেই গুরুতর। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যখন তোমরা মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না। তোমরা একে তুচ্ছ মনে করেছিলে, অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর অপরাধ।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ১৫)।
কোনো বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া শুধু অনুমানের ভিত্তিতে বলা চূড়ান্ত অপরাধ ও গুনাহের কাজ। এমন ধারণাপ্রসূত অপবাদ আরোপ থেকে বিরত থাকা উচিত। কোরআনে এসেছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাকো, নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা গুনাহ।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১২)।
কোরআনে এসেছে, যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর স্বপক্ষে চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের ৮০টি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরাই নাফরমান। (সুরা : নুর, আয়াত : ৪)।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানে বিরত থাকা
মিথ্যা সাক্ষ্যদান বর্তমান সমাজে ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি বিচারিক কার্যালয়েও মিথ্যা সাক্ষ্যের ছড়াছড়ি। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে রায়ও হয় এবং ব্যক্তিকে সাজা ভোগ করতে হয়। এর চেয়ে বড় জুলুম কী হতে পারে? যে সমাজে মিথ্যা সাক্ষ্য দেখা দেয়, সেই সমাজে ন্যায়, ইনসাফ থাকে না। হিংসা, বিদ্বেষ লেগে থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা উবে যায়। আমাদের ঠোঁট ও জবান আল্লাহর দান। আল্লাহ বলেন, ‘(আমি তাদের) জিহ্বা ও দুই ঠোঁট দিয়েছি।’ (সুরা : বালাদ, আয়াত : ৯)।
এগুলো দিয়েছেন সত্য কথা বলতে। সত্য সাক্ষ্য দিতে। যদিও তা নিজের কিংবা পিতামাতার বিরুদ্ধে যায়। কোরআনে এসেছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সংগত সাক্ষ্যদান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা মা-বাবার অথবা নিকটাত্মীয়ের যদি ক্ষতি হয়, তবু।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৩৫)।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানের কুফল
মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া কবিরা গুনাহ। নবীজিকে কবিরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা। মা-বাবার অবাধ্য হওয়া। হত্যা করা। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (বুখারি, হাদিস : ৬৯১৯)।
মিথ্যা সাক্ষ্যদান শিরকের সমতুল্য অপরাধ। ইবনে মাসউদ (রা.) মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরকের সঙ্গে তুলনা করে সুরা হজের ৩০-৩১ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করেন। অতএব, তোমরা বিরত থাকো মূর্তির নাপাকি থেকে এবং বিরত থাকো মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া থেকে, আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে শিরক করা ব্যতীত। মিথ্যা সাক্ষ্যদান গর্হিত জুলুম। আর জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ।
নবীজি (সা.) বলেছেন, অত্যাচারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অন্ধকারে থাকবে। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৮)।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানে অন্যের অধিকার নষ্ট হয়। যে ব্যক্তির অধিকার নষ্ট করা হবে, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া আল্লাহও অপরাধীকে ক্ষমা করবেন না। সর্বোপরি মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। এর চেয়ে বড় দুঃখ ও কষ্টের কিছু হতে পারে না।
Leave a Reply