নিজস্ব প্রতিনিধি , নোয়াখালী : একসময় সরকারের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দরপত্র কিংবা নিলাম আহবান প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হলেও এখন আর সে সুযোগ অতীত হয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠেছে।
এসব প্রতিষ্ঠানের দরপত্র কিংবা নিলামসহ যাবতীয় কাজেই চলছে রাজনৈতিক আধিপত্যের দৌরাত্ম্য। ফলে রাজনৈতিক দৌরাত্ম্যে অস্তিত্ব হারিয়ে চলছে সমাজ উন্নয়নকামী ঠিকাদারী পেশা।
একইসাথে বিলীন হয়ে গেছে ঠিকাদার কল্যান সমিতিসমূহও। রাজনৈতিক দুবৃর্ত্তায়নের প্রভাবে এখন আর সমাজের কোন ভদ্রজন এ পেশায় সম্পৃক্ত হননা সহজে।
সরেজমিনে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ঠিকাদারী পেশায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ঘটায় ঠিকাদারদের কল্যাণে সদস্যদের সম্মলিত উদ্যোগে স্থাপিত সমিতিগুলোর অস্তিত্বও প্রায় বিলীন।
একসময় সরকারের সড়ক ও জনপথ, জনস্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল, গণপূর্ত, পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্বাস্থ্য বিভাগসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সধারী ঠিকাদাররা কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সার্বিক নিয়ম কানুন মেনেই ঠিকাদারী করতেন।
সে সময়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগে আওয়ামী লীগের কোন নেতা ওই সমিতির সভাপতি হলে বিএনপির কোন নেতা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক কিংবা জাতীয় পার্টির কোন নেতা হতেন কোষাধ্যক্ষ। ওই প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদাররা কোন একটি কাজ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভাবগ্রস্তকেই দেয়ার সুপারিশ রেখে অন্যগুলো লটারীর মাধ্যমে সম্পন্ন করতেন। এতে সদস্যদের মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধও অনেক বেশি দায়বদ্ধ হতো।
বিগত কয়েক বছর ধরে প্রায় উন্নয়ণমুখী সংস্থাসমূহে শুধুমাত্র স্থানীয় সংসদ সদস্যরাই যেন একটি সমিতি। প্রতিটি বিভাগে তাঁদেরই কোন না কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে ওই বিভাগের সমস্ত কাজ কর্ম বিলি বণ্টন করার অধিকারী হয়ে চলছেন। ফলে লটারী নামক ভাগ্যখেলা এখন আর মুখেমুখে বলা হলেও কার্যত সবই এক ব্যক্তির আধিপত্যে চলে গেছে। এর ফলে বিলীন হয়েছে ঠিকাদারদের কল্যাণধর্মী সংগঠনসমূহও। ফলে এখন আর সমাজের কোন সভ্য, ভদ্র ও সুশিক্ষিত মানুষ ঠিকাদারীকে পেশা হিসেবে নিতে চাননা।
রাজনৈতিক দুবৃর্ত্তায়ণ ঘটায় অনেক ঠিকাদার তাদের লাইসন্সেগুলোও এখন আর নবায়নের প্রয়োজন মনে করছেনননা বলে জানান গণপূর্তের আরেকজন ঠিকাদার সাজ্জাদ হোসেনসহ অনেকে। ফলে সরকার বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারী লাইসন্সেসমূহ নবায়ন বাবত বিপুল অংকের রাজস্ব হারিয়ে চলছে সরকার।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির একজন নেতা ঠিকাদার মাহবুব আলমগীর আলো বলেন, গত এক যুগ ধরে সড়ক ও জনপথ বিভাগ কালো না সাদা বলতে পারবোনা। তিনি বলেন, অথচ একসময় এখানে ছিল সমিতির নিজস্ব একটি কার্যালয়। সেখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কিংবা অন্য দলের কোন ব্যক্তি সে যেই হোক ছিল সৌহার্দ্য, সম্মান আর সম্প্রীতির পারষ্পারিক বন্ধন। এখানে সমিতির কল্যাণে সবাই যে কোন উৎসবে, আয়োজনে শামিল হতেন। এখন এসব যাদুঘরেই চলে গেছে।
একইকথা বললেন আরেকজন আওয়ামী ঠিকাদারও। তিনি বলেন, ঠিকাদারী সমিতিতে আওয়ামী লীগের সিরাজ মিয়া সভাপতি থাকাবস্থায় বিএনপির গিয়াস উদ্দিন সেলিম ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। আজ সেসব যেন অনেক অতীত। যেন পুরোনো ইতিহাস।
গণপূর্তের এক ঠিকাদার বলেন, এখানে জাতীয় পার্টির নেতা আলী আকবর সভাপতি হলে বিএনপির বা আওয়ামী লীগের কোন নেতা, কর্মী বা সমর্থক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু গত এক যুগ ধরে এ কার্যালয়ের চৌহদ্দিতে থাকা ঠিকাদার কল্যাণ সমিতির কার্যালয়টিও বিলীন হয়ে গেছে।
আরেকজন পেশাদার ঠিকাদার বলেন, এখন ঠিকাদারী করতে হলে কিংবা নিজেকে এ পরিচয়ে টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনীতির প্রয়োজন হয়। তাও ক্ষমতাসীন রাজনীতির বাইরে গিয়ে ঠিকাদারী করার কোন সুযোগ থাকেনা। তাই এ পরিচয়টিও ছেড়ে দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, কেউ স্বীকার করেন বা নাই করেন এখন তো প্রায় বিভাগের নির্বাহীরা নামখাওয়াস্তে। কোন একটি কাজ কোন সংসদ সদস্যের নির্দেশিত প্রতিনিধির মাধ্যমে নগদ কমিশন দিয়ে পেয়েও শেষ পর্যন্ত সবাইকে খুশি করতে গিয়ে টিকে থাকা সহজ হয়ে ওঠেনা। তাই প্রায় ঠিকাদাররাও অন্যপেশায় চলে গেছেন।
এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, এটা ঠিক আমরা ক্ষমতায় আসার পর প্রায় বিভাগেই আমাদের সাংসদদের প্রতিনিধি হিসেবে যে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছেন।
অবশ্য এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের নির্বাহীদেরও রয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিদায়ী নির্বাহী বিনয় কুমার পাল এ নিয়ে নানা তিক্ততার কথা প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের। একই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকেশলী মো. নাসির উদ্দিনও। বললেন, প্রায় বিভাগের নির্বাহীরা অনেকটা প্রায় কেরানীর ন্যায়।
নোয়াখালীর সুশীল সমাজ মনে করে, সরকারের প্রতিটি বিভাগ সরকারী বিধিবিধানমতে অবাধ, উন্মুক্ত ও একটি সহায়ক পরিবেশে টেন্ডার প্রতিযোগিতা করা গেলে হারানো ঐতিহ্যটি ফিরে পেতে পারে ঠিকাদাররা।
Leave a Reply