বছরে দেড় লাখের বেশি নারী সাইবার প্রতারণার শিকার

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৪
  • 64 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি নারী সাইবার ও অন্যান্যভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ নারীর বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে। বাকিরা চল্লিশোর্ধ্ব। আর ভুক্তভোগীদের ৪০ শতাংশ ঢাকা বিভাগ বা ঢাকার আশপাশের বাসিন্দা। বাকি ৬০ শতাংশ নারী অন্যান্য বিভাগের।

‘ পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ’-এর একটি সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে ‘উইমেন’ সাপোর্ট সেন্টারে ১৫ হাজারের বেশি লিখিত অভিযোগ পড়ে এবং ফোনের মাধ্যমে আরও অভিযোগ পাওয়া যায়।

সূত্র জানায়, এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে সাইবার আক্রমণ, আইডি হ্যাক, ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইলিং, ইমপারসোনাল ব্ল্যাকমেইলিং, ছদ্মবেশে হয়রানি, কৌশলে ফোন নম্বর নিয়ে হয়রানি, ক্রেডিট কার্ডে প্রতারণা, বিকাশ প্রতারণা, অনলাইনসহ নানা ধরনের প্রতারণা। এসব অপরাধের নতুন উপকরণ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এটি সাইবার স্পেসে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভিকটিম করা হচ্ছে নারীদের। ছদ্মবেশধারীদের মাধ্যমে নারীরা ইমপারসোনাল ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার বেশি হচ্ছেন।

এ ছাড়া সাইবার বুলিং, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানো ও মোবাইল হ্যারাসমেন্ট, অনলাইন, ফোন ও এসএমএসের মাধ্যমে হয়রানির অভিযোগও কম নয়।

সূত্র জানায়, রায়হান নামের এক ব্যক্তি ছদ্মবেশে তার গার্লফ্রেন্ডের ধর্ষণের ধারণ করা ভিডিও দেখিয়ে কয়েকবার ব্ল্যাকমেইল করেন। পরে ভুক্তভোগী ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’-এর কাছে অভিযোগ করলে রায়হানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়।

এ ছাড়া শাহিন নামের এক ব্যক্তি আমিরুল নামে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে তার এক মেয়ে বন্ধুর একটি বাজে ভিডিও তৈরি করেন এবং সেটি তার রিয়েল আইডি দিয়ে তাকে পাঠান এবং বিষয়টি ভুক্তভোগীর কাছে জানতে চান। পরে এই সুযোগে প্রেমের নামে তাকে ব্ল্যাকমেইল করেন এবং নতুন করে আরেকটি ভিডিও তৈরি করেন। পরে ভুক্তভোগী তার পরিবারকে বিষয়টি জানালে তারা পুলিশের সহায়তা নেন। এ ঘটনার ১০ মাস পর তাকে মিরপুর থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

ছদ্মবেশে রায়হান ও আমিরুলের মতো হাজার হাজার মানুষ ফেসবুকে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা করছে। এতে নারীরাই বেশি হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

সূত্র জানায়, বর্তমানে টিকটক মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে সারা দেশে মানবপাচারের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে একটি চক্র। এ চক্রের সদস্যরা গত বছরে ভারতে প্রায় দুই হাজারের বেশি তরুণীকে পাচার করেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি এক প্রতারককে প্রেপ্তারের পর সে পুলিশকে জানায়, প্রতারকরা প্রবাসীদের স্ত্রীদের টার্গেট করে ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করে।

তাছাড়া আরেকটি চক্র আছে, যাদের টার্গেট শুধু প্রবাসী নারী। টার্গেট করা নারীদের ফেসবুক, মেসেঞ্জারে লিংক পাঠায় প্রতারকরা। পরে সেটা ক্লিক করলে ফেসবুক ইন্টারফেস আসে। ভিকটিমরা লিংকে প্রবেশ করার জন্য তাদের ফেসবুক আইডি এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয়। পরে প্রতারকরা তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের আইডি ও পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ফেলে এবং টাকা-পয়সা বা চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু নিয়ে কেউ কেউ আইডির পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ফেরত দেন বা কেউ দেন না।

ডিবি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান বলেন, একটি ওয়েবসাইটে সুন্দরী তরুণীদের নিয়ে কলগার্ল সার্ভিসের চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। পরে তাদের দিয়ে আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও করা হয়। এসব ছবি বা ভিডিও দেখিয়ে জিম্মি করে তাদের দিয়ে নানা ধরনের অবৈধ কাজ করানো হয়। ইতোমধ্যে এমন চক্রের একাধিক সদস্য আমাদের হাতে ধরা পড়েছেন।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ২০ বছর বয়সী একটি মেয়ে দীর্ঘদিন তার ছদ্মনামের ফেসবুক প্রোফাইলে যেসব ছবি আপলোড করেন, সেগুলো অন্যরা আজেবাজেভাবে ব্যবহার করে। পরে তিনিই আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন এবং জানান তিনি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছিলেন। চার থেকে পাঁচটি ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে আপত্তিকরভাবে এডিট করে কলেজ পড়ুয়া মেয়েটিকে পাঠানো হয় এবং তাকে হুমকি দেয়া হয় ও বলা হয়, ৪০ হাজার টাকা না দিলে এসব ছবি কলেজের গ্রুপে ভাইরাল করে দেয়া হবে। একই আইডি থেকে হয়রানির শিকার হন ১৯ বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে। তারা দুজনই থানায় জিডি করার পর পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইম্যানে যোগাযোগ করে প্রতারকদের শনাক্ত করে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেন। পরে জানা যায় তারা একে অপরের পরিচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অনেক মানুষ সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এসব অপরাধের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা দিতে সরকারি উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলকভাবে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে, বিশেষ করে ছাত্রীদের সুরক্ষাবিষয়ক সচেতনতামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষা দিলে এসব অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।

এ ব্যাপারে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তৌহিদ ভূঁইয়া বলেছেন, দেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, তার সব অভিযোগ পুলিশের কাছে আসেও না। বিচিত্র ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন নারী-পুরুষসসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। সামাজিক হেনস্তার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ না করে চেপে যান। এতে সাইবার অপরাধীরা আরও অপরাধের সুযোগ পায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি মুন্তাসিরুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীরা ব্যাপকভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রে বয়সসীমা নেই। যেকোনো বয়সের নারীই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেক পরিচয় বা কাউকে না চিনে বন্ধু বানানো ঠিক না। এসব প্রতিরোধে নারীদের এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!