দুর্নীতিতে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই

  • আপডেট সময় রবিবার, জুলাই ৭, ২০২৪
  • 95 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ৭ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

দুর্নীতি সমাজে যেন জেঁকে বসে আছে। এ দুর্নীতি প্রতিরোধ করাটাই এখন রাষ্ট্রের মূল কাজ। দেশের অনিয়ম দুর্নীতির মূল ক্রীড়নক হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। আর এ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করার কাজটা কোনো দিনই সম্ভব হবে না, কারণ চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।

সংবিধান অনুসারে প্রজাতন্ত্র তথা রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আর যারা সরকারী চাকুরী করেন তারা হলেন জনগণের কর্মচারী। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তা মনে হয় না। বরং দেখা যায় কর্মচারীরাই রাষ্ট্রের মালিক। তারাই দেশ পরিচালনার কলকাঠি নাড়ে, যার জন্য দুর্নীতি এখন সারা দেশে বন্যার জলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের কর্মচারীদের জন্য ১ থেকে শুরু ২০ নম্বর পর্যন্ত ২০টি গ্রেড রয়েছে। প্রতিটি গ্রেডের রয়েছে আলাদা বেতন ভাতাসহ সুযোগ সুবিধা। প্রজাতন্ত্রের এ সুযোগ ভোগকারীরা নিজেরাই নিজেকে রাষ্ট্রের মালিক মনে করছেন।

দেশের পুলিশ বিভাগ সবার দৃষ্টিতে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত। অথচ রাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় এ বিভাগটি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা, অপরাধ দমন, বিরোধ নিষ্পত্তিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরু দায়িত্ব এ পুলিশ বাহিনীর। বাংলাদেশে মোট থানা রয়েছে ৬৫২টি। এলাকাভেদে থানা এলাকাগুলোতে অপরাধের ধরনে রয়েছে নানা ধরনের বৈচিত্র্যতা। চুরি ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধের রকম একেক থানায় একেক ধরনের।

অপরাধের ধরন ও তার নানা ভিন্নতা ভেদে থানাগুলোর রয়েছে এক ধরনের আলাদা গুরুত্ব। যে থানায় বেশী অপরাধ সংগঠিত হয় সেই থানার গুরুত্ব এক ধরনের আর যে থানায় কম অপরাধ সংগঠিত হয় তার গুরুত্ব আরেক ধরনের। তাছাড়া সীমান্তবর্তী থাানা, বন্দর থানা, শিল্পাঞ্চল থানা এ রকম ধরনের বিষয়বস্তুহত কারণে থানাগুলোর গুরুত্ব আবার ভিন্নভাবে নির্ধারণ করা হয়। থানার প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন, তাকে অফিসার ইনচার্জ বা ওসি বলা হয়। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর ইন্সপেক্টর বা পরিদর্শক পদধারী পুলিশ কর্মীকে থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

একটি কথা ওপেন সিক্রেট যদিও এর দালিলিক প্রমাণ নেই তবে লোকমুখে প্রচারিত আছে যে, থানার গুরুত্বভেদে ওসি হিসেবে নিয়োগ পেতে বা বদলী হতে উপরের মহলকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। থানার গুরুত্ব বলতে যেখানে বেশী অপরাধমূলক কার্যক্রম সংগঠিত হয় তাকে গুরুত্বপূর্ণ থানা বলা হয়। যে থানায় বেশী অপরাধমূলক কার্যক্রম সংগঠিত হয়, সেখানে প্রচুর উপরি ইনকাম থাকে, তাই ওই থানাগুলোতে ওসি হিসেবে নিয়োগ পেতে বা বদলী হতে উপরের মহলকে বেশী টাকা ঘুষ দিতে হয় অন্য থানার ওসি হওয়ার (যেখানে কম অপরাধ হয়) চেয়ে।

যিনি মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেবেন কথিত গুরুত্বপূর্ণ থানার, তিনি ঘুষের টাকা কর্মস্থল থেকে উঠিয়ে নেবেন নিশ্চয়ই। তাহলে কি অপরাধমূলক কার্যক্রম কমবে না বাড়বে ? এতে কি প্রমাণ হয়, অপরাধ নির্মূল আদৌ কি এ পুলিশ বাহিনী দিয়ে সম্ভব হবে ? আইজিপি বেনজীর কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার পেছনে এ বদলী বাণিজ্যটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে বলে অনেকের ধারণা।

———————————————————————————————————————————————

এ ছাড়াও শোনা যায়, প্রতিটি থানা ও ফাঁড়ি থেকে মাসিক একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ( টাকার পরিমাণটা গুরুত্বভেদে কম বেশী হয় ) পুলিশ সুপার কার্যালয়ে দিতে হয়।

———————————————————————————————————————————————

পুলিশ সুপারের কার্যালয় আবার এ টাকার অংশ রেঞ্জ অফিসসহ পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠান। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, এ টাকাগুলো আসে কোথা থেকে ? নিশ্চয়ই জনগণ এ টাকা পুলিশ বাহিনীকে খুশী হয়ে দেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে, এলাকার অপরাধীরা বিভিন্ন অপকর্ম করে নিজেদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এ টাকা দিয়ে থাকেন পুলিশ বাহিনীকে। এভাবে কি অপরাধ নির্মূল হয় ? অনুরূপ ঘটনাটি ঘটে ভূমি নিবন্ধন দপ্তরে। যে এলাকার জমির মূল্য অনেক বেশী সেই এলাকার সাব রেজিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পেতে কর্তৃপক্ষকে বেশী ঘুষ দিতে হয়।

আবার অপেক্ষাকৃত কম ভূমির মূল্য এলাকায় বিনা পয়সায় বদলী হওয়া যায়। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, জনৈক ব্যক্তি বিসিএস (আবহাওয়া) এর সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পান, তারপর অপর আরেকটি বিসিএসে নন ক্যাডার হিসেবে সাব রেজিস্টার হিসেবেও তার নাম আসে। ওই ব্যক্তিটি সহকারী প্রকৌশলী (আবহাওয়া) ছেড়ে যোগ দেন সাব রেজিস্টার পদে চাকুরীতে।

যদিও এটা নন ক্যাডার পোস্ট, অপরদিকে সহকারী প্রকৌশলী ক্যাডার পোস্ট। এর কারণ আবহাওয়া অধিদপ্তরে ঘুষ নামক সুযোগ সুবিধাটা কম। তবে অন্যান্য প্রকৌশল দপ্তর হলে তিনি নিশ্চয়ই প্রথম চাকরীটা করতেন। কারণ দেশের প্রতিটি প্রকৌশল দপ্তরে অলিখিতভাবে চালু আছে পারসেন্টেজ প্রথা। এ বিষয়গুলো সবার জানা। তবে কেউ মুখ খুলছে না। তাই হয়তো নির্মূল হচ্ছে না।

প্রকৌশলীদের বদলীর ক্ষেত্রে রয়েছে তদবীর বাণিজ্য। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নির্বাচনী এলাকায় প্রকৌশলীরা বদলী হতে চায়, কারণ ওইসব এলাকায় বরাদ্দের পরিমাণ বেশী থাকে তাই কাজও বেশী হয়, পারসেন্টেজটা বেশী আসে। কাস্টমস, ভ্যাটসহ রাজস্ব বোর্ডের অধীন যারা চাকরী করেন তাদেরকেও দেখা যায় বদলীর ক্ষেত্রে তদবীর করতে। বন্দর এলাকা সমূহ এনআরবির কর্মীরা কর্মস্থল হিসেবে পেতে বেশী আগ্রহবোধ করে।

সরকারী টিআর, কাবিখার কিছু বরাদ্দ জনপ্রতিনিধিদের হাতে আছে। এ বরাদ্দগুলোও সরকারী কর্মীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, জনপ্রতিনিধি কর্তৃক বরাদ্দকৃত টাকাটা ওঠাতে সরকারী কর্মীদের উৎকোচ দিতে হয়। সরকারী চাকুরী মানে উপরি কামাই করার একটি স্থান, অনেক সরকারী বিভাগ আছে যেখানে কাজ অর্থাৎ অফিসে হাজির হলেই উপরি কামাই। তাই এখন সবার ঝোঁক সরকারী চাকুরীর দিকে।

সম্প্রতি মহামান্য আদালত সরকারী কর্মীদের সম্পদ বিবরণী প্রদানের বিষয়ে একটি আদেশ দিয়েছেন। এটা মেনে চলা সব দপ্তরের দায়িত্ব। দুদক নামক দন্তহীন দপ্তরটি দুর্নীতি দমন করতে পারছে না। তাই আদালতের নিয়মানুসারে প্রত্যেকটি সরকারী কর্মীর এসিআরের সময় তার প্রতি বছর সম্পদের বিবরণী দাখিল করাটা বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। বেতন বহির্ভূত যদি কোনো আয় তার থাকে তাহলে তা কিভাবে আসল এবং তা থেকে তার আয় কত এ কথাগুলোও থাকতে হবে।

বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়ন ও উপজেলা জেলারও রয়েছে পৃথক পৃথক ওয়েব সাইট। উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত (ইউএনও থেকে শুরু করে চৌকিদার পর্যন্ত) প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব বিবরণী, “ উপজেলা সরকারী কর্মী ” নামে ওয়েব সাইটে প্রতি বছর জুলাই মাসে প্রকাশ করতে হবে যাতে করে উপজেলার প্রতিটি জনগণ তা দেখতে পারে। কারণ জনগণের প্রদেয় কর দিয়ে সরকারী কর্মীদের বেতন ভাতা সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়।

বেতন প্রদানকারী জনগণ তার কর্মচারী কি পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছে তা দেখার অধিকার রাখে। তাই সরকারীভাবে এমন সিদ্ধান্তটা আসা উচিৎ। উপজেলার ন্যায় জেলা, বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে দপ্তরগুলো ও সচিবালয়ে কর্মরতদের জন্য এ ধরনের ওয়েব সাইট খুলতে হবে। সেখানে তাদের সম্পদের হিসাব বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সব বিষয়গুলো লেখা থাকবে।

রাষ্ট্রের মালিক জনগণ তাই যে কোনো নাগরিক যে কোনো সময় তার কর্মচারীর বিষয়গুলো জানতে পারবে। কোনো সরকারী কর্মীর সম্পদের বছর ওয়ারী বিবরণীতে অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে জনগণই তা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা নিতে পারবে। সম্পদের পাশাপাশি সরকারী কর্মীদের পোষ্য সংখ্যা কত, তারা কি পড়াশোনা করে নাকি চাকরী করে তাও উল্লেখ করতে হবে।

প্রত্যেক সরকারী কর্মীর নিজের স্বাক্ষরিত একটি হলফনামা সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে, যেখানে সে শপথ পূর্বক লিখবে যে, উল্লিখিত সম্পদের বাইরে তার কোনো সম্পদ নাই, যদি থাকে তাহলে রাষ্ট্র তা বাজেয়াপ্ত করতে পারে। এ রকম হলফনামা থাকলে জনগণ ঠিকই দুর্নীতিবাজ ধরতে পারে। অবসরে যাওয়ার সময় কত টাকা তার আছে (পেনশনসহ) তা অবসর গ্রহণ করা এলাকার ওয়েবসাইটে উল্লেখ করে অবসরে যাবেন এ রকম বিধানও এখানে করতে হবে এ ক্ষেত্রে।

সরকারী কর্মীরা জনগণের চাকরী করেন তাই জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা থাকা দরকার। এক্ষেত্রে দুদকের ভূমিকা গৌণ হলেও সমস্যা হবে না। এখন মুখ্য ভূমিকায় দুদক কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছরে দুর্নীতি তো কমাতে পারেনি দুদক বরং রাষ্ট্রের সরকারী কর্মীর দুর্নীতি বেড়েছে জ্যামিতিক হারে।

সুতরাং উপরোল্লিখিত ব্যবস্থা নিতে পারলে আর বদলী বাণিজ্য ও অন্যান্য মাধ্যমে অবৈধ উপার্জন করাটা বন্ধ হবে। তখন আর ওপেন সিক্রেট দুর্নীতি থাকবে না।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!