হাতিয়া গিলে খাচ্ছে ৬৫০ কার্গোর ঢেউ

  • আপডেট সময় শনিবার, আগস্ট ৩১, ২০২৪
  • 70 পাঠক

সাব্বির ইবনে ছিদ্দিক । হাতিয়া, নোয়াখালী।

প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যে ঘেরা দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া । যেখানে নীল আকাশ আর সাগরের মেলবন্ধনে মিলে এক অসীম শান্তি, মানুষের হৃদয়ে জাগায় নতুন স্বপ্নের বীজ। নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার অন্যতম প্রধান সমস্যা নদীভাঙন।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বর্ষায় স্বাভাবিক নদীভাঙনের পাশাপাশি নতুনভাবে যোগ হয়েছে অভ্যন্তরীণ কার্গো জাহাজ চলাচল সমস্যা। প্রতিদিন প্রায়-৬০০ থেকে ৬৫০ কার্গো জাহাজ নদীর কুল ঘেঁষে চলাচল করায় প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে বাড়ছে নদীভাঙন।

এতে করে ভাঙছে হাতিয়া উপজেলার পুরো জনপদ। পাশাপাশি চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নদী তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র মানুষদের।

কার্গো জাহাজগুলো দ্বীপের কুল ঘেঁষে চলাচলের কারণে বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করে প্রচন্ড গতিতে তীরে আঘাত হানে। জাহাজের ঢেউয়ের আঘাতের ফলে ভেঙে পড়ছে দ্বীপের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, ঘর-বাড়ি, হাট-বাজারসহ জনপদের বিভিন্ন অবকাঠামো। বর্তমানে শুধু বর্ষা মৌসুমে নয়, বারো মাসই হাতিয়ায় নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতিসহ নানা স্থাপনা।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো. সাইদুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, নদী ড্রেজিংয়ের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। সেটি হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। এ সময় বিশ্বব্যাংকের পিডি আইয়ুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের পিডি আইয়ুব আলী বলেন, নদী ড্রেজিংয়ের কার্যক্রমে কোনো সরকারি নির্দেশনা আসেনি। আগের প্রকল্পটি এখানে বাস্তবায়ন হয়নি। কোনো ধরনের নতুন প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়নি। নতুন কোনো প্রকল্প বরাদ্দ হলে চ্যানেলটি ড্রেজিং করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তৈরি পোশাক, পাটজাত দ্রব্য, চা, চাল, ওষুধসহ বিভিন্ন রফতানি পণ্য ও খনিজ তেল, রাসায়নিক সার, স্টিলের যন্ত্রপাতি, পাথর, সিমেন্ট, কয়লাসহ অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, আরিচা, আশুগঞ্জ, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বাঘাবাড়ী, খুলনা, বরিশাল, চিতলমারীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৬৫০ মালবাহী কার্গো জাহাজ হাতিয়া চ্যানেলটি ব্যবহার করছে। এ ছাড়াও ভারতের কিছু পণ্যবাহী জাহাজ হাতিয়া চ্যানেলটি ব্যবহার করে।

প্রাকৃতিক নিয়মে নদীর মাঝখানে অসংখ্য ডুবোচর জেগে ওঠেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দীর্ঘ সময় ড্রেজিং কার্যক্রম না থাকার কারণে নদীর খাড়ি বা গভীরতম স্রোত ফুলের দিকে চলে এসেছে। রাত বিরাতে কার্গো জাহাজ নদীর কূল ঘেঁষে চলাচল, নোঙর করাসহ নানা উপদ্রব নিয়ে এক বিরূপ পরিবেশে দিন কাটছে নদী তীরে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষের। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এসব সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ বা প্রকল্প গ্রহণ করেনি বিআইডব্লিউটিএ কিংবা সংশ্লিষ্ট অধিদফতর।

এ বিষয়ে প্রিমিয়ার সিমেন্টের নিজস্ব জাহাজের মাস্টার মিলন কাজী বলেন, একটা সময়ে হাতিয়ার এই চ্যানেলটি নদীর মাঝখানে ছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে এই চ্যানেলে বালু জমে অনেক ডুবোচরের সৃষ্টি হওয়ায় পানির প্রবাহ ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ দিকে সরে আসে। সাধারণত পানির প্রবাহ বা পানি যেখানে বেশি থাকে সেখানে দিয়েই জাহাজ চলাচল করে। ডুবোচরের সংখ্যা এবং পরিধি বৃদ্ধির কারণে ক্রমান্বয়ে চ্যানেলটি নদীর কূলের কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই বাধ্য হয়েই এখন আমাদের কুল ঘেঁষে জাহাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ড্রেজিং না করার কারণে আগের চ্যানেলে আর জাহাজ চলাচল করতে পারে না।

নাবিক মিজানুর রহমান বলেন, হাতিয়া চ্যানেলে শত শত মালবাহী জাহাজ চলাচলের কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। এতে করে প্রতিনিয়তই নদী পাড়ের মাটিতে বড় বড় ফাটল দেখা দেয় ও খসে পড়ে। সারা বছরই এভাবে মাটি ধস অব্যাহত থাকে। জাহাজ চলাচলের সময় প্রায়ই বিআইডব্লিউটিএর পাইলটরা সঙ্গে থাকেন। তারা সবকিছু স্বচক্ষে দেখার পরেও কেন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তা বোধগম্য নয়।

বৃদ্ধ মফিজ মাঝি বলেন, এ পর্যন্ত ৯-১০ বার ঘর সরাইছি। আগে অনেক জমি-জমা আছিল। সব এই নদী খাইছে। এখন আর তবিল নাই যে, কোথাও গিয়া নতুন বাড়ি-ঘর তুলমু। কত সরকার আর কত নেতা আইলো গেলো। হেতেরা খালি হেতেগো বস্তা গুছাইছে। নদীভাঙন বন্ধ করবারলাই কেউ কিছু করে নাই। শুনছি নতুন সরকার আইছে, এইবার যদি কিছু করে।’

স্থানীয় বাসিন্দা গৃহিণী মালেকা বেগম বলেন, ‘আমার ঘরের পাশেই নদী। এমনিতেই প্রতিনিয়ত নদীভাঙন লেগেই আছে। সেই সঙ্গে ঘরের পাশ দিয়ে জাহাজ চলাচলের কারণে যে আওয়াজ ও কম্পন হয় তাতে মনে হয়, এই বুঝি আমার ঘর পড়ে গেল! ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। অনেক কষ্টে দিন পার করি। সামর্থ্য নাই যে স্থায়ী কোনো জায়গায় গিয়া থাকব।

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা আবদুল কাদের বলেন, আগে জাহাজ চলত অনেক দুর দিয়ে যা খালি চোখে দেখাই যেত না। আর এখন ঘরের একেবারে পাশেই জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকে। এই জাহাজগুলোর কারণে নদী বেশি ভাঙে। আমার পাশের অনেকে অন্যত্র গিয়ে বাড়ি-ঘর বাঁধছে। তাদের টাকা-পয়সা আছে তাই যেতে পারছে। আমার টাকা-পয়সার জোর না থাকায় নদীর ধারেই পড়ে আছি। বারবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে নদীর কাছাকাছি সরকারি জায়গায় অথবা বেড়িবাঁধের ধারে ঘর স্থানান্তরিত করতে হয়। প্রতি বছরই নদীভাঙনসহ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়তে হয়।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!