দুদকের গোড়াতেই দলীয় গলদ

  • আপডেট সময় রবিবার, আগস্ট ১৮, ২০২৪
  • 23 পাঠক

চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার সব সিদ্ধান্ত নেন। বাকিরা শুধু আজ্ঞাবহ।

নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ নেই। আইনজীবী নিয়োগ পান দলীয়রা।

দুদকে কর্মকর্তা–কর্মচারী রয়েছেন ১২০০ জন।

অর্থের বিনিময়ে অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার অভিযোগ আছে।

গত ২০ বছরে বিভিন্ন অপরাধে শাস্তি হয়েছে ৩০০ কর্মকর্তা–কর্মচারীর।

দিশারী ডেস্ক। ১৮ আগস্ট ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

ছোটখাটো দুর্নীতি ধরার ক্ষেত্রে দুদক স্বাধীন। সরকার না চাইলে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান বা মামলা করে না সংস্থাটি। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কাগজে-কলমে স্বাধীন হলেও সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান শুরু করে না। সব সময় ক্ষমতাসীন সরকার দুদককে দলীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ফলে সংস্থাটির ভেতরেও অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে।

দুদক সূত্র বলছে, মামলা করা পরের কথা, সরকার না চাইলে কোনো দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানই শুরু করে না দুদক। কোনো বড় ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসার পর অনুসন্ধান শুরু করলেও তা আর এগোয় না। উল্টো দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও কাউকে কাউকে দায়মুক্ত ঘোষণা করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একাধিক পরিচালক ও মহাপরিচালক বলেন, ছোটখাটো দুর্নীতি ধরার ক্ষেত্রে দুদক স্বাধীন। আর হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন না তাঁরা। সরকারের ইশারায় মাঝেমধ্যে দু-একজনের বিরুদ্ধে লোকদেখানো তদন্ত করলেও পরে তা থেমে যায়। ফলে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে সংস্থাটি।

কর্মকর্তারা বলেন, দুদককে কখনো স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় না দলীয় সরকার। যাঁদের দায়িত্ব দেয়া হয়, তাঁরা সরকারের লোক। তাই নিয়োগ পাওয়ার পর তাঁরা সরকারের স্বার্থের বাইরে কাজ করেন না।

কোনো বড় ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসার পর অনুসন্ধান শুরু করলেও তা আর এগোয় না। উল্টো দুর্নীতির প্রমাণ থাকার পরও কাউকে কাউকে দায়মুক্ত ঘোষণা করা হয়।

সংকেতের অপেক্ষা

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের অঢেল সম্পদ নিয়ে গত মার্চ মাসে সংবাদ প্রকাশ করে একটি জাতীয় দৈনিক। এরপর ১৮ এপ্রিল দুদক কমিশন সভায় বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। অনুসন্ধানের পর সম্পদ জব্দ করা হলেও মামলা করা হয়নি।

শুধু বেনজীর নন, সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তাঁর বিরুদ্ধে আগেও একাধিকবার অনুসন্ধান করে দুদক। তখন সরকার-ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা না করে দায়মুক্তি দেয়া হয়। দায়মুক্তি নিতে মতিউর বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করেন বলে অভিযোগ আছে। এবার দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়ার কথা বলা হলেও দুদক এখন পর্যন্ত মামলা করেনি।

দুদকের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গণমাধ্যমে বেনজীর ও মতিউরের বিপুল সম্পদের খবর প্রকাশের পর সরকারের উচ্চ মহল থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তবে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের খবর প্রকাশের পরও দুদক অনুসন্ধান শুরু করেনি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর বিপুল সম্পদ থাকার খবর আগে থেকেই গণমাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছিল। খবরে বলা হয়, তাঁদের নামে বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ জমা রয়েছে। বিদেশে অর্থ জমা রাখার ব্যাপারে তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অনুমতি নেননি।

গত ৪ মার্চ এসব প্রমাণ ও নথি টিআইইউকে ও টিআইবির উদ্যোগে বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডি, এনবিআর ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

——————————————————————————————————————————-

সব আমলেই দলীয় সরকার দুদককে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও একাধিক সংস্থা ও ব্যক্তি দুদক নিয়ন্ত্রণ করেছে। দুদককে এভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

——————————————————————————————————————————–
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ব্যাংকগুলোকে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের হিসাব জব্দ করার নির্দেশনা দেয়। তবে দুদক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

গত জুলাই মাসে চীন সফর থেকে ফিরে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার বাসায় কাজ করেছে, পিয়ন ছিল সে, এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। বাস্তব কথা। কী করে বানাল এত টাকা ? জানার পরই ব্যবস্থা নিয়েছি।

সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলার পর শেখ হাসিনার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলমের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কাছে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। দুদক সূত্র জানায়, তাদের গোয়েন্দা শাখা প্রাথমিক অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া শুরু করলেও তা আর এগোয়নি।

অবশ্য হাসিনা সরকারের পতনের পর আর্থিক খাতে আলোচিত নাম চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল ও শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুটপাটের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুদক। একই সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে সংস্থাটি। তবে এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল করার পরও দুদক চুপ ছিল। এখন সরকার পতনের পর অনুসন্ধান শুরু করার কথা ঘোষণা করেছে।

গোড়াতেই গলদ

দুদকের কর্মকর্তারা বলেন, দুদকের সব সিদ্ধান্ত নেন চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার। এর বাইরে দুদকের কোনো কর্মকর্তা স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান শুরু করা কিংবা মামলা করতে পারেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন মহাপরিচালক একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন , তদন্ত কর্মকর্তারা দূরের কথা, আমি একজন মহাপরিচালক হয়েও কোনো দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।

দুদকের গোড়াতেই গলদ উল্লেখ করে এই মহাপরিচালক বলেন, দুদকে চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের জন্য একটি সার্চ কমিটি রয়েছে ; কিন্তু কোনো নীতিমালা নেই। যে কারণে সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছাড়া কেউ নিয়োগ পান না। নিয়োগ পেয়ে তাঁরা সরকারের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেন।

দুদক প্রতিষ্ঠার ২০ বছরেও নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ হয়নি। নিয়োগ দেয়া হয় দলীয় আইনজীবীদের। ফলে দলীয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংস্থাটির শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। দুদকে সারা দেশে ১ হাজার ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন। বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে ২০ বছরে প্রায় ৩০০ কর্মীর নানা ধরনের সাজা হয়েছে বলে জানা যায়।

ঢেলে সাজাতে হবে

দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে দুদককে আপাদমস্তক ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সব আমলেই দলীয় সরকার দুদককে নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও একাধিক সংস্থা ও ব্যক্তি দুদক নিয়ন্ত্রণ করেছে। দুদককে এভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় শীর্ষ ও মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। সৎ ও পেশাদার কর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে দুদকের কোনো কর্মকর্তা যাতে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে না পড়েন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!