মো. আবদুর রহমান। ০৮ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
আল্লাহভীতি আদর্শ মানুষের জীবনের মূলভিত্তি। আল্লাহকে ভয় করার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহকে সম্মান প্রদর্শন এবং তার সম্পর্কে জেনে তাকে ভয় করা, তার আদেশ পালন করা এবং তার নিষেধ থেকে বিরত থাকা।
আল্লাহভীতির গুরুত্ব : আল্লাহকে ভয় করার গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি কঠোর শাস্তিদাতা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘ হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো যেরূপ ভয় করা উচিত। আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (সুরা আলে ইমরান ১০২) এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, আল্লাহকে যথার্থরূপে ভয় করতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করে আল্লাহ তার সব বিষয় সমাধান করে দেন।
একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় গুণ হলো সে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে, তার কাছে ক্ষমা চায় এবং ধৈর্যধারণ করে। কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সেই দিনকে ভয় করো, যেদিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তিত হতে হবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেকে পাবে তার নিজ নিজ কর্মফল। আর সেদিন তাদের ওপর কোনো অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা বাকারা ২৮১)
———————————————————————————————————————————————
আল্লাহ এখানে তার বান্দাদের নসিহত করে বলেছেন, এ দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, এখান থেকে তোমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। সুতরাং তোমরা আমাকে ভয় করো এবং সেদিনের ব্যাপারে সদা সতর্ক হও। কারণ তোমাদের কৃতকর্মের জন্য সেদিন তোমাদের শাস্তি বা পুরস্কার দেয়া হবে।
———————————————————————————————————————————————
আল্লাহর ভয়ে নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দূরে থাকা বা যে কাজ করার কারণে মানুষকে আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়, তা থেকে নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। আর যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় রয়েছে এবং যারা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকেন তাদের বলা হয় মুত্তাকি।
মূলত যার অন্তর যত পরিষ্কার এবং যার অন্তরে আল্লাহর ব্যাপারে যত বেশি ভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞান আছে, সে আল্লাহকে তত বেশি ভয় করে। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই কেবল তাকে ভয় করে।’ (সুরা ফাতির ২৮) আর স্বীয় রব সম্পর্কে বান্দার জ্ঞান যত বাড়বে, তার প্রতি তত বেশি ভয় তৈরি হবে। ফলে সে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন সে তাকে দেখছে।
আল্লাহভীতি প্রকৃতই একটি পবিত্র বৃক্ষতুল্য। এ পবিত্র বৃক্ষ যার অন্তরে যখন অঙ্কুরিত হয়, তখনই তা তার দেহেও সম্প্রসারিত হয়। তার কথা, কাজ ও সৎকর্মের মাধ্যমে তা ফলবান হয়। কোনো অন্তর যখনই এই পবিত্র বৃক্ষের অঙ্কুরশূন্য হয়, তখন ওই অন্তর বিরান হয়ে যায়। তার অন্তর বিনষ্ট হয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে আল্লাহর ভীতি থেকে মুক্ত অন্তর অবশ্যই বিরান অন্তর। আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত অন্তরের তুলনা পবিত্র বৃক্ষের সঙ্গে সত্যিই অতুলনীয়।
এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি লক্ষ করোনি, আল্লাহ কীরূপে উপমা দিয়ে থাকেন ? তিনি উত্তম কথার তুলনা প্রদান করেন উত্তম বৃক্ষের সঙ্গে, যে বৃক্ষের মূল সুদৃঢ় এবং শাখা-প্রশাখা আকাশসম বিস্তৃত।’ (সুরা ইব্রাহিম ২৪) তিনি আরও বলেন, ‘আর তিনি অনুত্তম কথার উপমা দেন অনুত্তম বৃক্ষের সঙ্গে, যার মূল মৃত্তিকার উপরিভাগ থেকেই বিচ্ছিন্ন এবং যার কোনো স্থায়িত্ব নেই।’ (সুরা ইব্রাহিম ২৬) আল্লাহর বান্দাদের মর্যাদা ও সুকীর্তি মূলত আল্লাহভীতি নির্ভর।
আল্লাহভীতির ফজিলত : কোরআন-হাদিসে আল্লাহভীতির অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। মানুষের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে আল্লাহভীতি। এই ভয় মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করার শক্তি জাগ্রত করে। ফলে মন্দ ও অশ্লীল কাজের অসংখ্য পথ উন্মুক্ত থাকার পরও আল্লাহভীরু মানুষ নিজেকে তা থেকে বিরত রাখে। দুর্নীতির উন্মুক্ত পরিবেশ বিদ্যমান থাকার পরও সে তা এড়িয়ে চলে।
আল্লাহভীতি মানবজীবনকে এমন এক সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে, যা সব ধরনের ভীতি, লালসা, প্রতারণা, প্রলোভন ও পদস্খলন থেকে নিরাপদ রাখে। হারাম বর্জন ও হালাল গ্রহণ করতে প্রেরণা জোগায়। এ ভয় অন্তরাত্মাকে সদা সুশোভিত করে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ হে মুমিনরা! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে তিনি তোমাদের ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করার শক্তি দান করবেন, তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহ মহাঅনুগ্রহশীল।’ (সুরা আনফাল ২৯)
আল্লাহভীতি মানুষকে অন্যায় ও পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা আল্লাহভীরু এবং সৎকর্মশীল।’ (সুরা নাহল ১২৮)
যারাই আল্লাহভীরু তারাই সৎকর্মশীল। আল্লাহভীতি অন্তরের আলো। এ আলো দ্বারাই অন্তরের ভালো-মন্দ চেনা যায়। কোনো অন্তর থেকে যখন আল্লাহর ভয় চলে যায়, তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় যখন মানুষের অন্তরে শেকড় গেড়ে বসে যায়, তখন সে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়।
প্রকৃতপক্ষে আল্লাহভীতির আগুনে পুড়ে মানুষ যেমন প্রবৃত্তি ও কামনাকে ভস্মে পরিণত করতে পারে, তেমন আর কোনোভাবেই পারে না। এ ভয়ের কারণে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মন নিয়ন্ত্রণে থাকে, আত্মা শুদ্ধ ও পবিত্র হয়। অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকার দূর হয়ে যায়। আল্লাহর ভয়ে মুমিন ব্যক্তি সারা দিন ভীত থাকে। মূলত প্রকৃত ইমানদার সেই, যে সদা সর্বদা আল্লাহতায়ালার ভয়ে শঙ্কিত থাকে। সে অন্তর থেকে দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতা সমূলে উৎপাটন করে ফেলে। আল্লাহর অসীম ক্ষমতায় বিশ্বাসের জন্য তার আত্মার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি সে সুদৃঢ় ও পবিত্র মনোবলের অধিকারী হয়।
——————————————————————————————————————————————–
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান ব্যক্তি কে ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘ যে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু।’ (সহিহ বুখারি) যারা আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তাদের জন্য আসমান ও জমিনের নেয়ামত উন্মুক্ত করে দেন। আল্লাহর নৈকট্য ও সহায়তা লাভের জন্য আল্লাহভীতির কোনো বিকল্প নেই।
——————————————————————————————————————————————-
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখো নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা ১৯৪) এ আল্লাহভীতিই মূলত প্রত্যেককে খাঁটি মুসলমানে পরিণত করার অন্যতম উপায়। সুতরাং মুমিন মুসলমানদের উচিত, আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তার ভয় কামনা করা, যার মাধ্যমে নিজেদের অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হবে। রাসুল (সা.) আল্লাহর ভয় কামনা করে এরূপে দোয়া করতেন, ‘ হে আল্লাহ! প্রকাশ্য ও গোপনে সর্বাবস্থায় আপনার ভয়ভীতি কামনা করছি।’ (সুনানে নাসায়ি)
আল্লাহভীতি অর্জনের উপায় : আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্বের চিন্তা করা, কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা, রাসুল (সা.)-এর বাণী নিয়ে চিন্তা করা, ইবাদতে (নামাজ, রোজা, জাকাত ও হজ) কোনো ধরনের অবহেলা না করা, অতীত গুনাহের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হওয়া, আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন নিয়ে চিন্তা করা, মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করা এবং কবরজীবন নিয়ে ভাবা। কেয়ামতের ভয়াবহতা ও জাহান্নামের শাস্তি নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করলে মন নরম হবে এবং অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হবে।
মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। তাই জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তার নির্দেশ পালন করা এবং তার শক্তি ও শাস্তি নিয়েও চিন্তা করা উচিত। এতে অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি হবে। দুনিয়াতে আল্লাহকে ভয় করা আখেরাতে নিরাপত্তার মাধ্যম। এ ভয় উভয় জগতে সফলতা ও কামিয়াবির পথ। আল্লাহভীতি পরিপূর্ণ ইমানের দলিল। এ ভয় ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য, আত্মার পরিশুদ্ধি ও কলবের পবিত্রতার নির্দেশক।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের অন্তরে তার ভয় জাগ্রত করার তওফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply