কাসেম শরীফ। ১০ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।
বিরোধ, বৈপরীত্য ও বৈচিত্র্য মানব মনের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য। এটি রোধ করা সম্ভব নয়। এই বিরোধের চূড়ান্ত মীমাংসা হবে পরকালে। তাই দুনিয়ার জীবনে যথাসাধ্য সহাবস্থানের বিকল্প নেই।
মানুষের মধ্যকার বিরোধ অবধারিত হলেও সব মানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ এবং মানবীয় আচরণ প্রদর্শন ইসলামের শিক্ষা। কারণ মানুষ হিসেবে সবাই সম্মানিত।
হাদিসে এসেছে, একদিন সাহল ইবনে হুনাইফ (রা.) ও কায়েস ইবনে সাদ (রা.) কাদেসিয়ায় বসা ছিলেন। তখন তাঁদের পাশ দিয়ে একটি লাশ নিয়ে কিছু লোক অতিক্রম করল। তাঁরা দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন তাঁদের বলা হলো লাশটি অমুসলিমের। তাঁরা বলেন, মহানবী (সা.)-এর পাশ দিয়ে একসময় একটি লাশ নেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে বলা হলো এটা তো এক ইহুদির লাশ। তখন তিনি বলেন, ‘ সে কি প্রাণ (মানুষ) নয়? ’ (বুখারি, হাদিস : ১২৫০)
উপাসনালয়ে হামলা করা অপরাধ
মূর্তি ভাঙা ইসলামের চোখে অপরাধ। গির্জায় হামলা করা অপরাধ। কারো উপাসনালয়ে হামলা করা যেকোনো আইনের চোখে অপরাধ। শান্তির ধর্ম ইসলাম এ বিষয়ে সর্বাধিক সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
জিহাদ ও ইসলামে বলপ্রয়োগের নীতির একটি উদ্দেশ্য হলো : ‘ আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত খ্রিস্টান সংসারবিরাগীদের উপাসনাস্থল, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ, যার মধ্যে আল্লাহর নাম বেশি স্মরণ করা হয়।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪০)
জোর করে কাউকে মুসলিম বানানো নিষিদ্ধ
ইসলাম পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয় এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির সঙ্গে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করে। কোনো অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার অবকাশ নেই। ধর্মের ব্যাপারে যেকোনো ধরনের বলপ্রয়োগ ও জবরদস্তি ইসলামে নিষিদ্ধ।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘ দ্বিন গ্রহণে জোর-জবরদস্তি নেই ; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে…।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তাদের ওপর জবরদস্তিকারী নও। তবে কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে ও কুফরি করলে আল্লাহ তাকে কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত করবেন।’ (সুরা : গাশিয়া, আয়াত : ২২-২৪)
অমুসলিম নাগরিকের নিরাপত্তা চুক্তি
মুসলিম দেশে অমুসলিম নাগরিকের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মুসলমানদের কর্তব্য। প্রসিদ্ধ ফতোয়াবিষয়ক গ্রন্থ ‘বাদায়ে’-এর মধ্যে বলা হয়েছে : ‘ অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চুক্তি করা আমাদের (মুসলমানদের) জন্য বাধ্যতামূলক। মুসলমানরা কোনো অবস্থায়ই এ চুক্তি ভঙ্গ করতে পারবে না। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের পক্ষে তা বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ তারা যদি আমাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চায় তাহলে তা করতে পারবে।’ (আদ্দুররুল মুহতার, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১১২)
অমুসলিম নাগরিকের সম্পদ ও সম্পত্তি দখল করার অধিকার কারো নেই। ওমর (রা.) গভর্নর আবু উবায়দা (রা.)-কে যে ফরমান পাঠিয়েছিলেন, তাতে এ নির্দেশও ছিল : ‘ মুসলমানদের অমুসলিমদের ওপর জুলুম করা, কষ্ট দেয়া এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পত্তি ভোগদখল করা থেকে বিরত রেখো।’ (কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা-৮২)
পূজনীয় বস্তুকে গালি দেয়া নিষিদ্ধ
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পূজনীয় বস্তুকে গালি দিতে নিষেধ করেছেন মহান আল্লাহ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের উপাসনা (পূজা-অর্চনা) করে তোমরা তাদের গালাগাল কোরো না, তাহলে তারা অজ্ঞতাবশত বৈরীভাবে আল্লাহকেই গালাগাল দিতে শুরু করবে। আমি (আল্লাহ) এভাবেই প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য তাদের কর্ম চাকচিক্যময় করে দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে তাদের রবের কাছে ফিরে যেতে হবে, তখন তারা কী কী কাজ করেছিল তা তিনি তাদের জানিয়ে দেবেন।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১০৮)
মদিনা সনদে ধর্মীয় সহাবস্থান
সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা, পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাসের স্বীকৃতি ইসলামের বিঘোষিত অঙ্গীকার। হঠকারিতা, বৈষম্য, বঞ্চনা ইসলামের শিক্ষা নয়; বরং একটি ঝঁনসরংংরাব সমাজ বিনির্মাণ ইসলামের প্রাত্যহিক চেতনা। এ জন্যই হিজরতের পর প্রিয় নবী (সা.) সম্প্রীতিমূলক বা ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেন।
প্রিয় নবী (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি (সা.) পাঁচ ধরনের মানুষের সংশ্লেষের এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। তারা হলো : মুহাজির, আনসার, ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক। তখন নবী (সা.)-এর প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হয় ভ্রাতৃবিরোধ, বিদ্বেষ-বিগ্রহের অবসান ঘটান। এ লক্ষ্যই ছিল মদিনা সনদের প্রধান অর্জন।
অমুসলিমদের সামাজিক অধিকার
মুসলিম দেশে সংখ্যালঘুরা মুসলমানের মতোই সামাজিক অধিকার ভোগ করে থাকে। সমাজে তাদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করার কোনো সুযোগ নেই। সমাজে সংখ্যালঘুদের সামাজিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ইসলাম বদ্ধপরিকর। আল্লাহ তাআলা অমুসলিমদের সঙ্গে সুবিচারপূর্ণ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘ যারা দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও ইনসাফ (সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা) করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
অন্যায়ভাবে অমুসলিমের ক্ষতি সাধনের শাস্তি
যেসব অমুসলিম মুসলিম দেশে রাষ্ট্রের আইন মেনে বসবাস করে অথবা ভিসা নিয়ে মুসলিম দেশে আসে, তাদের সুরক্ষা ও জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ অন্যায়ভাবে অমুসলিম নাগরিকের ক্ষতি সাধন করলে দেশীয় আইনে তার শাস্তি হবে। পাশাপাশি পরকালে সে জাহান্নামে যাবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘ যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৯৫)
মহান আল্লাহ আমাদের দেশকে সব ধরনের অপরাধ ও ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করুন।
Leave a Reply