দিশারী ডেস্ক। ৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সেবা খাতে এক লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) খানা জরিপে এই তথ্য ওঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সেবা খাতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তিনটি খাত হচ্ছে পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ গড় ঘুষ গ্রহণকারী হচ্ছে বিচারিক সেবা, ভূমি ও ব্যাংকিং খাত।
মঙ্গলবার ধানমণ্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ-২০২৩ ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। দেশের আট বিভাগের ১৫ হাজার ৫১৫টি পরিবারের তথ্য এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৩ মে থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।
এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা দীর্ঘদিনের। সমাধান, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারগুলো প্রয়োগ হয় না। বহুমাত্রিক হাতিয়ার হিসেবে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হয় ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে। এর কোনোটাই দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে খাতগুলোর দুর্নীতি নির্মূলের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, তারাই বেশি দুর্নীতি করছে।
——————————————————————————————————–
তিনি বলেন, বিচারিক সেবা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতি ও ঘুষের উচ্চ হার অব্যাহত রয়েছে, যা সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে ভূমি সেবা, পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও বিআরটিএর মতো সেবায় উচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষ বিদ্যমান, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ সেবাপ্রাপ্তির অধিকার বাধাগ্রস্ত করছে। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে দুর্নীতি বেশি হয়েছে। জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না বলেই দুর্নীতি বাড়ছে।
——————————————————————————————————–
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
গোয়েন্দা সংস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যোগসাজশে ব্যাংক দখলও হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পাসপোর্ট অফিস দুর্নীতি রোধে অনেক কথাই বলে, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। দুদক সবচেয়ে অকার্যকর ও ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর সরকারি অফিস, বিশেষ করে পাসপোর্টে সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি করা হয়, যা থেকে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও সুবিধা পেয়ে থাকেন। দুর্নীতিবাজদের আগের মতো মানুষ ঘৃণা করে না। দুর্নীতিবাজদের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করা হয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সভাপতি করা হয়। দুর্নীতি নির্মূলে অন্তর্বর্তী সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
——————————————————————————————————–
দেশের ১৭টি সেবা খাতের ওপর জরিপ চালিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ (এপ্রিল) সাল পর্যন্ত সেবা খাতে জাতীয় পর্যায়ে মোট ঘুষের ন্যূনতম প্রাক্কলিত পরিমাণ এক লাখ ৪৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। এই সময়ে সার্বিকভাবে দুর্নীতির শিকার ৭০.৯ শতাংশ খানা এবং ঘুষের শিকার ৫০.৮ শতাংশ খানা।
——————————————————————————————————–
সর্বোচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষের হার পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়। ২০২৩ সালে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১.৪৩ শতাংশ এবং জিডিপির ০.২২ শতাংশ। এই পরিমাণ অর্থ দেশের মানুষ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিয়েছে।
জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সেবা পেতে পরিবার বা খানাপ্রতি সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ৬৮০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। গড় ঘুষের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা ও ব্যাংকিং খাতে। সেবা পেতে ৭০.৯ শতাংশ পরিবার দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আর ৫০.৮ শতাংশ পরিবার ঘুষের শিকার হয়েছে। সর্বোচ্চ দুর্নীতি ও ঘুষের হার পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়।
প্রতিবেদেনে বলা হয়, বিআরটিএতে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৮৬ শতাংশ আর প্রতিষ্ঠানটিতে ঘুষ দিতে হয়েছে ৭১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে। পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৮৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা এবং ঘুষ দিতে হয়েছে ৭৪.৮ শতাংশের।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৭৪.৫ শতাংশ, ঘুষ দিতে হয়েছে ৫৮.৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে। বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৬২.৩ শতাংশ, ঘুষের শিকার ৩৪.১ শতাংশ। ভূমি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার ৫১ শতাংশ, ঘুষ দিতে হয়েছে ৩২.৩ শতাংশকে।
Leave a Reply