দিশারী ডেস্ক। ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।
‘গুলিতে আমার ডাইন হাতটা অবশ অইয়া গেছে। চিকিৎসা কেমনে করবাম, চিকিৎসা করবার মতো হাতে আর কোনো টেহা-পয়সা নাই।’ কথাগুলো বলছিলেন বিগত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ নেত্রকোনার কেন্দুয়ার আলমগীর। আহত আলমগীর উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের পাথাইরকোনা গ্রামের মৃত মুখসুদ আলীর পুত্র।
আলমগীর ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি এক সন্তানের জনক। শ্রম বিক্রি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। ক’মাস আগে নিজ এলাকায় কোনো কাজ না থাকায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে চলে যান নরসিংদী জেলার শিবপুর থানা এলাকায়। সেখানে ইটাখলা মোড়, মুন্সির হাট চরে ভাড়া করা বাসায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন।
আলমগীর বলেন, এ ঘটনাটি ঘটেছে বিগত ১৯ জুলাই রাত আনুমানিক ৮টার দিকে।
ওই দিন দুপুর থেকে নরসিংদী জেলার ইটাখলা মোড় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার বারবার সংঘর্ষ হচ্ছিল। এতে বেশ কয়েকজন লোক আহত ও নিহত হন। চোখের সামনে পুলিশ মানুষকে গুলি করে মারছে। এ দৃশ্য নিজের চোখে দেখার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে আলমগীর তার ২০/২৫ জন সঙ্গী নিয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষে আন্দোলনে অংশ নেন।
তিনি আরো বলেন, নিজের চোখে দেখতেছি যেভাবে মানুষ গুলি করে মারতাছে তাতে আমরার বাইচ্চিয়া থাইক্কিয়া লাভ কী ? তখন একটা স্টিলের পাত সংগ্রহ করে বুকের মধ্যে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নেমে যাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
রাত ৮টার দিকে গুলিবিদ্ধ হই। পরে সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে শিবপুর উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক আমার অবস্থা আশংকাজনক দেখে নরসিংদী জেলা সদর হাসপাতালে পাঠান। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকলে সেখানেও আমাকে ভর্তি করা হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করার পরামর্শ দেন।
এ সময় আলমগীরের বড় বোন নাজমা আক্তারের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, গুলিতে আহত হওয়ার খবর পেয়ে আমি ও আমার ছেলেরা প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভাইকে ভর্তি করি। সেখানে বারবার আমাদের কাছে জানতে চায় আমার ভাই আলমগীর নরসিংদী কারাগারে হামলা করেছে কিনা। কিন্তু না করার পরও বারবার জিজ্ঞাস করতে থাকায় গ্রেপ্তারের ভয়ে সেখান থেকে আমার ভাই পালিয়ে যায়। আমার অপর এক ভাইয়ের সহযোগিতায় ২১ জুলাই হাসপাতাল থেকে পালিয়ে লালবাগ থানা এলাকায় ইসলামবাগে ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেয়।
————————————————————————————-
আলমগীর আরো বলেন, ভাইয়ের বাসায় ১২ দিন ছিলাম। সেখানে ভয়ে ভয়ে দিন কেটেছে। কোনো ভালো চিকিৎসা নেয়া যায়নি। সেখানেও বলাবলি হতে থাকল, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজন লোক ইসলামবাগ এলাকায় থাকে। পরে সেখান থেকে পালিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার পুরুরা এলাকায় বোনের বাসায় আশ্রয় নেই। বেশ কিছুদিন এখানে থাকার পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর থেকেই পরিবেশ অন্য রকম হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেই।
————————————————————————————-
এখনো আমার হাত সম্পূর্ণ সুস্থ না। চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকার মতো ঋণ করেছি। এখন হাতে আর কোনো টাকা-পয়সা নেই। আমার ডাইন হাতটা অবশ হইয়া গেছে। সব সময় চিনচিন করে ব্যথা করে। আমার ঋণ পরিশোধ ও হাতের চিকিৎসার জন্য সরকারের নিকট আর্থিক সহযোগিতা চাই।’
আলমগীরের মা রহিমা খাতুন বলেন, আমার ছেড়া (ছেলে) দিন আনে দিন খায়। পুলিশের গুলি খাইয়া ডান হাতটা অবশ হইয়া গেছে। চিকিৎসা করতে তিন লাখ টাকার মতো ঋণ করছে। এই টাকা কিভাবে দিবে এই চিন্তায় সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। তাছাড়া তার হাত অবশ থাকায় কাজও করতে পারে না। আমি মা হিসাবে সরকারের কাছে আমার পুতের (ছেলের) সংসারডারে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করছি।
Leave a Reply