দিশারী ডেস্ক। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।
উন্নত জীবনের আশা আর জীবিকার সন্ধানে চরম বিপদসংকুল জেনেও অবৈধ পথে প্রতিনিয়ত বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। তাঁদের অনেকেরই গন্তব্য ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্র ইতালি। ভীষণ বিপজ্জনক পথে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগরের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ জলপথ পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে ইতালিতে যাচ্ছেন বহু বাংলাদেশি।
———————————————————————————————-
বিপজ্জনক পথে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগরের মতো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ জলপথ পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া থেকে ইতালিতে কেন যাচ্ছেন বহু বাংলাদেশি, কতজন পৌঁছাতে পারছেন আসল গন্তব্যে ?
———————————————————————————————-
অনেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন আবার কেউ কেউ যাত্রাপথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন। এই পুরো বিপদসংকুল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় আদম পাচারকারী ও দালালদের মাধ্যমে অবৈধ প্রক্রিয়ায়। অনেকেই চরম ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল পথ পাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় মারা যান। প্রতিকূল পরিবেশে সীমান্ত ও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিয়মিত বিরতিতে মৃত্যুর মুখে পড়ছেন সোনার হরিণের আশায় অভিবাসনপ্রত্যাশী হাজারো বাংলাদেশি।
লিবিয়া যাওয়ার পথ
বৈধ পথে যেসব অভিবাসনপ্রত্যাশী কাজের সন্ধানে ইতালি যেতে পারেন না তাঁদের একমাত্র ভরসা আন্তর্জাতিক আদম পাচারকারী ও তাদের সহযোগী দালাল। এসব পাচারকারীর সহায়তায় বিরাট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে (১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ পর্যন্ত) বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে বিদেশগামীদের নেয়া হয় দুবাই। দুবাই থেকে তাঁদের পাঠানো হয় তুরস্ক কিংবা মিসর। দালালেরা সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয় লিবিয়ায়, পরে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে যায় ইতালি।
মূলত লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে জনপ্রিয় ও বিপজ্জনক তিনটি ধাপ আছে। লিবিয়ায় যাওয়ার পর দালালদের মাধ্যমে তাঁদের একটি দলে ঢোকানো হয়। পরে তাঁদের সাগরে কম্পাস (দিক নির্ণয়ের যন্ত্র) ধরে পথ চেনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় লিবিয়ার জোয়ারা ও তাজোরা উপকূল থেকে। যাত্রা শুরুর পর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাই নৌকা চালাতে শুরু করেন। দালালেরা তখন সঙ্গে থাকেন না। ভূমধ্যসাগরে নৌকা ছাড়ার পর ভাগ্যাহত এসব অভিবাসীর দায়িত্বও কেউ নেয় না। তখন একমাত্র ভরসা ভাগ্যবিধাতা।
সম্প্রতি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মজুমদারকান্দি এলাকায় ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া সুজন হাওলাদারের স্ত্রী মুন্নী বেগমের আহাজারি। ছবি : অন্য দৈনিক
পরে অভিবাসীদের সমুদ্রপথে নেয়া হয় ইতালির সিসিলি দ্বীপে। কিন্তু কয়েক দিনের প্রশিক্ষণে সাগরে ঠিকভাবে দিক নির্ণয় করা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অনেক সময় ভুল করে নৌকা চলে যায় ভূমধ্যসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায়। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে লিবিয়ায় ফেরত পাঠানো হয়। অনেকে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশিতে কম্পাস দিয়ে দিক নির্ণয় করতে না পারায় ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যান বা সলিলসমাধি হয়। অনেক সময় এই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সংশ্লিষ্ট কোস্টগার্ড সদস্যরা লিবিয়া কিংবা তিউনিসিয়া বন্দরে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে ঠিকানা হয় অন্ধকার কারাগার।
ভূমধ্যসাগরে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে সিসিলি দ্বীপে নৌকা পৌঁছানোর পর শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপের কাজ। এ সময় অভিবাসীরা সমুদ্রে টহলরত ইতালির নৌবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তাঁদের পাঠানো হয় কারাগারে। কারাগার থেকে শুরু হয় তৃতীয় ধাপের পরিকল্পনা।
———————————————————————————-
ইতালিসহ ইউরোপের অনেক দেশে বৈধভাবে শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকে ঝুঁকি নিয়ে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাচ্ছেন। তাই ওই সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বৈধভাবে শ্রমিক নেওয়ার সংখ্যা বাড়াতে সরকারকে জরুরিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
অধ্যাপক সি আর আবরার, নির্বাহী পরিচালক, রামরু
———————————————————————————-
এই ধাপ হলো ‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’ বা রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া। ইতালির পুলিশ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সেটি অনুমোদন হলে অবৈধ অভিবাসীরা ইতালিতে থাকতে শুরু করেন। আর অনুমোদন না হলে তাঁদের ইতালি ছেড়ে বাংলাদেশে ফেরত যেতে সপ্তাহখানেকের মতো সময় দেয় ইতালির পুলিশ।
সবাই কি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন
উন্নত জীবনের আশায় জীবনকে হাতের মুঠোয় করে প্রতিবছর অবৈধ পথে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করে অনেক বাংলাদেশি। ভূমধ্যসাগরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার বাহন ছোট বা মাঝারি সাইজের নৌযান। অনেক সময় নৌযানের পাটাতনের ভেতরে থেকে দীর্ঘ জলপথ যাত্রায় অনেকে দম বন্ধ হয়ে মারা যান। অনেকে ‘হাইপোথার্মিয়া’ বা অতিরিক্ত ঠান্ডায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তখন সহযাত্রীরা তাঁদের মরদেহ সমুদ্রেই ভাসিয়ে দেন। তারপরও একটু উন্নত জীবনের আশায় থেমে নেই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ইতালিযাত্রা।
———————————————————————————————
ইনফো মাইগ্রান্টসের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ৪ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইতালি গেছেন। নৌকাডুবিসহ নানাভাবে মারা গেছেন ৭০০–এর বেশি মানুষ। আর ২০২৩ সালে সমুদ্রপথে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টার সময় নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ হাজার ৭৬০ জন অভিবাসী।
———————————————————————————————
সম্প্রতি লিবিয়ার পূর্ব উপকূলে মোট ২৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দেশটির ত্রিপোলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, ২৩ জনের মরদেহ উদ্ধারের পর লিবিয়ার ব্রেগা অঞ্চলের আজদাদিয়া হাসপাতালে সেগুলোর গোসল করানো হয়। সেই কাজে একজন বাংলাদেশি যুক্ত ছিলেন। গলিত লাশের অবয়ব দেখে তাঁর মনে হয়েছে, নিহত ব্যক্তিদের সবাই বাংলাদেশি।
গুগল ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী লিবিয়া থেকে ইতালির দূরত্ব ১ হাজার ৭৭৮ কিলোমিটার। এই দূরত্বে যেতে পাচারকারী ও তাদের দালালেরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ছোট নৌকায় গাদাগাদি করে নেয়। অনেক সময় বাতাস দিয়ে ফোলানো নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সলিলসমাধি হয় তাঁদের। এভাবেই ভয়ংকর জলপথ পাড়ি দিয়ে স্বপ্নের ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন অনেক বাংলাদেশি ; যাঁদের বেশির ভাগেরই বাড়ি শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায়।
কেন ইতালি যাচ্ছেন
ইতালিতে আয়রোজগার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ সহজ। একবার স্থায়ী হতে পারলে উন্নত জীবনের হাতছানি। এ ছাড়া অনেকেই ইতালি যাওয়ার পর সুযোগ বুঝে গ্রিস, স্পেন কিংবা ফ্রান্সে যান।
বাংলাদেশিরা ইতালিতে গণহারে বেশ কয়েক বছর ধরে বেশি যাচ্ছেন। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত ইতালির শ্রম ও সামাজিক পরিকল্পনাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ কাগজপত্রসহ ১ লাখ ৫০ হাজার ৬৫২ জন বাংলাদেশি সেখানে থাকছেন, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে ইতালিতে অবৈধ বাংলাদেশির সংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি।
ইতালির একটি গ্রামে জমিতে কাজ করছেন অভিবাসী কৃষি শ্রমিকেরা ।ফাইল ছবি : রয়টার্স
ইতালিতে যেসব জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি যান তার মধ্যে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চাঁদপুর অন্যতম। জনশ্রুতি আছে, শরীয়তপুরের প্রতিটি ঘর থেকে কমপক্ষে একজন করে ইতালি থাকেন। তাই আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব থাকার কারণে এসব অঞ্চল থেকে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে দেশটিতে অভিবাসী হওয়ার প্রবণতা বেশি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ থেকে দালালদের মাধ্যমে যাঁরা ইউরোপে যান, তাঁদের বড় একটা অংশ দেশে কোনো কাজ করেন না। তাঁদের আরেকটি অংশ যান গ্রাম থেকে, যাঁরা পারিবারিকভাবে কৃষিকাজে জড়িত। নির্মাণ খাত বিশেষ করে প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ানরাও বিদেশে যান। আরেকটি অংশ যান যাঁরা দেশের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মুদিদোকানসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতেন। মূলত উন্নত জীবনের আশায় এসব মানুষ ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হন। দেশের মধ্যে পর্যাপ্ত আয়ের ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথটাই অনেকে বেছে নেন।
——————————————————————————————-
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ইতালি আসা অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সমুদ্রপথে ইতালি এসেছে ৪৯ হাজার ৬৯১ জন।
——————————————————————————————-
পরিসংখ্যান কী বলে
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্ডার এজেন্সি ফ্রন্টটেক্সের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর, ২০২৪ সালে ৮ হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঢুকেছে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৫৭৪ জন এসেছে কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর দিয়ে, ৬০৪ জন পূর্ব ভূমধ্যসাগর দিয়ে আর বাকি ৪৩৭ জন ঢুকেছে পশ্চিমের বলকান দিয়ে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে ২১ হাজার ৭০০ অবৈধ অভিবাসীকে ভূমধ্যসাগর থেকে আটক করেছে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। এর মধ্যে দেড় হাজার নারী ও ৭০০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত মামুন শেখের বাড়িতে চলছে মাতম। সম্প্রতি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল এলাকায় । ছবি : অন্য দৈনিক
বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে ‘ ইনফো মাইগ্রান্টস ’। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ইতালি আসা অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সমুদ্রপথে ইতালি এসেছে ৪৯ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে ১২ হাজার ৭০২ জন বাংলাদেশি, যা মোট আগমনের শতকরা ২০ ভাগ। ইনফো মাইগ্রান্টসের তথ্যমতে, তুর্কি কোস্টগার্ড ২০২৪ সালে দেশটির উপকূল থেকে ৫৫ হাজার ৪৬৭ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করে।
এদিকে ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশটিতে বর্তমানে ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অবৈধভাবে রয়েছেন। এর মধ্যে কতজন জেলে আছেন সেটি সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। তবে ইতালিতে অবৈধভাবে বসবাসকারী মধ্যে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি পাসপোর্টের তথ্য সংশোধনের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এই সুযোগ চলতি বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত থাকবে।
বর্তমানে বৈধ প্রক্রিয়ায় ইতালিতে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ আছে। দেশটি চাইছে, ইতালিতে অবৈধভাবে থাকা ৫০ হাজারের বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত নতুন করে দেশটিতে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ থাকবে। তারপরও মানব পাচারকারী ও দালালেরা থেমে নেই।
——————————————————————————————-
মানব পাচার নিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে অসংখ্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তারপরও অবৈধ পথে লিবিয়া ও ইতালিযাত্রা থেমে নেই। ২০-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করে এ দেশের মানুষ ইতালি যাচ্ছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সৈয়দ সাইফুল হক, চেয়ারম্যান, ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন
——————————————————————————————-
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে ৪ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অবৈধ পথে ইতালি গেছেন। আর নৌকাডুবিসহ নানাভাবে মারা গেছেন ৭০০–এর বেশি মানুষ। আর ২০২৩ সালে সমুদ্রপথে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টার সময় নিখোঁজ বা মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ হাজার ৭৬০ জন অভিবাসী। এর মধ্যে কয়েক শ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হয়।
লিবিয়া হলো ‘ট্রানজিট রুট’
বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ভয়ংকর রুটের ট্রানজিট হলো লিবিয়া। লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার জানান, দেশটির কারাগারে বর্তমানে ৪১০ জন বাংলাদেশি আছেন, যাঁরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় ধরা পড়েছেন।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যায় অভিবাসীরা। ছবি : রয়টার্স
বর্তমানে লিবিয়ায় ২১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে কাজ করছেন, যাঁদের শতকরা ৮০ ভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নাই। গত বছর ৪ হাজার ২০০ জন বাংলাদেশিকে লিবিয়া থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে জানিয়ে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাছে মানব পাচারকারী এবং দালালদের তালিকা আছে। এই মাফিয়ারা খুব প্রভাবশালী উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের ধরে কঠোর শাস্তি দেওয়া না হলে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়া ও মৃত্যুর মিছিল থামবে না।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
প্রায় চার দশক ধরে অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক জানান, হিউম্যান স্মাগলিং বা মানব পাচার নিয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে অসংখ্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে। তারপরও অবৈধ পথে লিবিয়া ও ইতালিযাত্রা থেমে নেই। ২০-২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করে এ দেশের মানুষ ইতালি যাচ্ছেন, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং লিবিয়া ও ইতালির এম্বাসিতে মানব পাচারকারী এবং তাদের দালালদের তালিকা আছে। গণমাধ্যমে রিপোর্ট হলে অপরাধীদের ধরা হয় ; কিন্তু কদিন পরে এসব প্রভাবশালী জামিনে বের হয়ে আসে। পরে আবার শুরু করে মানব পাচার।
সাগর থেকে অবৈধ অভিবাসীদের উদ্ধার করে ইতালির কোস্ট গার্ড । ছবি : রয়টার্স
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মাইগ্রেশন স্টাডিজের শিক্ষক ড. মো. জালাল উদ্দীন শিকদার বলেন, আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া ঠেকানো যাচ্ছে না। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ১৫-২০ লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে ইতালি যাচ্ছে। এদের থামাতে হলে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম।
ড. জালাল মনে করেন, কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে যাওয়ার প্রবণতা কমতে পারে।
সমাধান কী
বাংলাদেশে অভিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট, রামরু। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার)। তাঁর মতে, অবৈধভাবে ইতালি যাওয়া বন্ধ করতে হলে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। মানব পাচার ঠেকাতে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি “অ্যাকশন প্ল্যান” তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকারের মধ্যে এমন কোনো তৎপরতা দেখি না।
অধ্যাপক আবরার বলেন, বাস্তবতার নিরিখে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর “ মাইগ্রেশন পলিসি ” করা উচিত। তা না হলে বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশ থেকে অবৈধভাবে মানব পাচার ঠেকানো যাবে না।
এ ছাড়া ইতালিসহ ইউরোপের অনেক দেশে বৈধভাবে শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকে ঝুঁকি নিয়ে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশে যাচ্ছেন। তাই ওই সব দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বৈধভাবে শ্রমিক নেয়ার সংখ্যা বাড়াতে সরকারকে জরুরিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
Leave a Reply