স্বাস্থ্যঝুঁকি || বাহারি নামের বস্তায় ভেজাল ও নিম্মমানের চাল

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ৮, ২০২১
  • 737 পাঠক

দিশারী রিপোর্ট||

বস্তা দেখে আসল মনে হলেও ভেতরে হুবহু নকল। নোয়াখালীর বাজারে বাহারি নামে, আকর্ষণীয় বস্তায় যেসব চাল বিক্রি করা হয়, তার অধিকাংশই ভেজাল ও নিম্মমানের বলে অভিযোগ করছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকারের নোয়াখালী শাখার কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, এ চালে যে ক্রেতারা শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তাই নয়, প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি পালিশ করা, কৃত্রিম রং মেশানো ভেজাল চালের ভাত খাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখেও পড়ছেন সাধারণ গ্রাহক।

অন্যদিকে, ভেজালের ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত মিল মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে মিনিকেটের ভেজাল প্রচলিত। মোটা চাল পালিশ করে মিনিকেট নামে বিক্রি হয়। তবে বর্তমানে নাজিরশাইলসহ চিকন ও সরু চালের বস্তায় মোটা চাল ভরে নতুন ধরনের প্রতারণা শুরু হয়েছে। ভোক্তাদের পকেট থেকে চিকন বা সরু চালের টাকা নিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মূলত মোটা চাল।

সোনাপুরের গৃহিণী শিফিকা আক্তার জানান, তিনি নাজিরশাইল নামে ৫০ কেজির একটি চালের বস্তা কিনে আনার পর ভেতরে দেখেন অন্য জাতের চাল। যা বাজারে বস্তাপ্রতি আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়া। ভেজাল চালে এভাবে প্রতারিত হওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে আহত হয়েছেন। সোনাপুরের এই গৃহিণী বলেন, ভাত বাঙ্গালীর প্রধান খাদ্য। এদেশে ছোট থেকে বয়স্ক প্রতিটি সদস্যের প্রধান খাদ্য এটি। এই চালেও যদি ভেজাল হয় তবে কী খেয়ে বাঁচবে দেশের মানুষ !

এদিকে, নোয়াখালীর চালের বাজারের ভেজালের দায় নিচ্ছে না কেউ। মিল মালিকরা বলছেন, তারা ভালো মানের চাল বস্তায় ভরে আড়তে দেয়ার পর, অসৎ ব্যবসায়ীরা দ্রুত সেই ব্র্যান্ডের বস্তার ছাপ হুবহু নকল করে নিম্নমানের চাল আড়তে সরবরাহ করে।

সোনাপুরের আড়তদার আবদুর রব, আবুল খায়ের ও আবুল কালাম বলছেন, তারা মিল মালিকদের কাছ থেকে যে বস্তা পান খুচরা পর্যায়ে তাই সরবরাহ করেন। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা ভোক্তার কাছে বিক্রি ছাড়া চাল প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো কিছুর সঙ্গেই জড়িত নয়,ফলে তাদের মাধ্যমে ভেজাল করার সুযোগ নেই। যখন মিল মালিক, আড়তদার, খুচরা বিক্রেতা কেউই চালের ভেজালের দায় নিচ্ছে না, তখন প্রশ্ন ওঠে ভেজালটা হচ্ছে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে বিস্ময়কর তথ্য।

সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুরের পর দেশের যেসব জেলা থেকে ভালোমানের চাল সরবরাহ হয়, তার মধ্যে শেরপুর অন্যতম। এই জেলায় রয়েছে অসংখ্য অটো রাইসমিল। এখানে তুলসীমালা, কালোজিরা, চিনিগুঁড়ার মতো সুগন্ধি চাল ছাড়াও ভালো মানের নাজিরশাইল চাল প্রক্রিয়াজাত করা হয়। শেরপুরের একটি অটোরাইস মিল থেকে ব্র্যান্ডের নাজিরশাইল চাল সরবরাহ করা হয়, দেশে যার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার কারণে ওই ব্র্যান্ডের চালের বস্তা হুবহু নকল করে শেরপুর থেকে নরসিংদী হয়ে ভেজাল চাল সরবরাহ করা হচ্ছে।

তবে নোয়াখালীর এক আড়তদার বলেন, শেরপুরের অটোরাইস মিলের নাজিরশাইল চালের ব্যাপক চাহিদা থাকায় অসৎ ব্যবসায়ীরা নরসিংদী থেকে একই ধরনের বস্তা নকল করে ভেজাল চাল সরবরাহ করছে। ফলে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন তাই নয়, মিল মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ ভেজাল চাল কিনে প্রতারিত হওয়ার পর কেউ আর এই ব্র্যান্ডের চাল নিতে চাইবে না।

শেরপুরের নাজিরশাইল চাল নরসিংদীতে ভেজাল হলেও সেখানে উৎপাদনকারী এলাকা হিসেবে নালিতাবাড়ি,শেরপুরের নামই উল্লেখ রয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নামও এক। চালের বস্তায় উল্লেখিত মোবাইল নম্বরে অবিকল ব্যবহার করে থাকে এ প্রতারকরা।

নোয়াখালীর সোনাপুরের এক চাল দোকানী জানান, সারাদেশেই এখন ভালো ব্র্যান্ডের নামে নকল বস্তায় নিম্নমানের চাল সরবরাহ করা হয়। ভেজাল বা নিম্নমানের চাল সরবরাহ প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী বলেন, আমরা যখন চৌমুহনী থেকে চাল সংগ্রহ করি, তখন জানতে চাওয়া হয় কোন নামের চালের বস্তা হবে। বাজারে যে ব্র্যান্ডের চাল ভালো, আমরা সেটির নাম বলে দেই।

তিনি বলেন, চৌমুহনী বাজারেও কম্পিউটারে ছাপ দিয়ে বস্তা তৈরি করে ওই বস্তা পুরো দেশই সয়লাব কর যায়। শুধু শেরপুরের নয়, টাঙ্গাইলের সোনার বাংলাসহ দেশে ভালো ব্র্যান্ডের যত চাল আছে তার সব বস্তা নিমিষেই এভাবে নকল করে দেদার ভেজাল চাল বিক্রি করা হয় বলে জানান এই ব্যবসায়ী।

নোয়াখালীর ভোক্তা অধিকারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, মোটা, মাঝারি মোটা বা লম্বা-মোটা চালকে কাটিং এবং পলিশ করে চিকন বা সরু চালের দামে বিক্রয় করে ভোক্তা ঠকানো হচ্ছে যা নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এর পঞ্চম অধ্যায়ে ৩১ ও ৩২ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকারের সভাপতি আবদুল মান্নান ভুইয়া বলেন, খাদ্যে ভেজাল যে অপরাধ এটি জেনেও অনেকে এ ধরনের ভেজালের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, চালে ভেজালের কারণে ভোক্তা শুধু যে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, প্রতারিত হওয়ার ফলে মানসিকভাবেও পর্যুদস্ত হচ্ছেন। উপরন্তু নিম্নমানের চাল ভোক্তার পরিবারে প্রতিটি সদস্যের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। আবদুল মান্নান ভুইয়া বলেন, আইনে যে কোনো ধরনের খাদ্য সেটি কোন জেলা থেকে উৎপাদিত হবে লেবেলে সেটি উল্লেখ করতে হবে। ফলে শেরপুরের চাল নরসিংদী থেকে শেরপুরের নামে সরবরাহ করাও অপরাধ।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান,তারা যখনই সুস্পষ্ট অভিযোগ পাচ্ছেন, ত্বরিত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!