নিষিদ্ধ পাকিস্তানী রং ফর্সাকারী ক্রিমে মাত্রাতিরিক্ত পারদ ও হাইড্রোকুইনোন

  • আপডেট সময় রবিবার, জুন ২০, ২০২১
  • 590 পাঠক

নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা

—————————————————

পাকিস্তান উৎপাদিত বাংলাদেশে চালু থাকা আটটি রং ফর্সাকারী ক্রিমের মধ্যে পারদ (মার্কারি) এবং পারদ ও হাইড্রোকুইনোনসহ অন্যান্য উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

গত বছর সেগুলো নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এই আটটি নিষিদ্ধ ক্ষতিকারক ক্রিম বিক্রির অনুমোদন না থাকলেও কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী গোপনে অবৈধভাবে আমদানি করে বিক্রি করছে এসব রং ফর্সাকারী দ্রব্য।

রাজধানীর ফার্মগেট, নিউমার্কেট, বসুন্ধরা শপিংমল, চকবাজারসহ অন্যান্য এলাকায় বেশ কয়েকটি শপিংমলে গিয়ে দেখা যায় নিষিদ্ধ এই ক্রিমগুলো গোপনে অথবা দোকানে সাজিয়ে রেখে বিক্রি করছে বিক্রেতারা। বিভিন্ন নামে বৈধ-অবৈধ এসব রং ফর্সাকারী ক্রিমে বাজার সয়লাব।

বিএসটিআই জানিয়েছে, গত বছর বাজারের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রং ফর্সাকারী ১৩টি ক্রিম বিএসটিআই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। বিএসটিআইয়ের নিয়মিত সার্ভিল্যান্স টিমের মাধ্যমে এসব ব্র্যান্ডের পণ্য ক্রয় করে পরীক্ষা করা হয়। সেখানে ছয়টি পণ্যের মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পারদ (মার্কারি) আর দুটি পণ্যের মধ্যে পারদ (মার্কারি) ও হাইড্রোকুইনোন পাওয়া গেছে। এসব পণ্য আমদানি, খোলাবাজার কিংবা অনলাইনে বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

বাংলাদেশ মান (বিডিএস ১৩৮২:২০১৯) অনুযায়ী এ ধরনের ক্রিমে পারদের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ১ পিপিএম এবং হাইড্রোকুইনোনের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫ পিপিএম। মাত্রাতিরিক্ত পারদ ও হাইড্রোকুইনোনযুক্ত এসব ক্রিম দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে চর্মরোগসহ বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

বিএসটিআই যেসব পণ্য নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো হলো- গৌরি কসমেটিকস লিমিটেডের গৌরি, এস জে এন্টারপ্রাইজের চাঁদনী, কিউসি ইন্টারন্যাশনালের নিউ ফেস, ক্রিয়েটিভ কসমেটিকস (প্রা.) লিমিটেডের ডিউ গোল্ডেন, পার্ল কসমেটিকসের গোল্ডেন পার্ল, পুনিয়া ব্রাদার্সের ফাইজা নুর, গোল্ড কসমেটিকসের নুর, হোয়াইট পার্ল কসমেটিকসের হোয়াইট পার্ল প্লাস।

বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পাকিস্তানের গৌরি কসমেটিকসের গৌরি ব্র্যান্ডের স্কিন ক্রিমে পারদের মাত্রা ৭৫৫.৮৫ পিপিএম; এস জে এন্টারপ্রাইজের চাঁদানী ব্র্যান্ডের ক্রিমে ৬২৯.৯৬ পিপিএম; কিউ সি ইন্টারন্যাশনালের নিউ ফেস ক্রিমে ৫৯০.৩৮ পিপিএম; ক্রিয়েটিভ কসমেটিকসের ডিউ ক্রিমে ২৮৫.৮৮ পিপিএম; গোল্ডেন পার্ল কসমেটিক্সের গোল্ডেন পার্ল ক্রিমে ৬৫৪.১৩ পিপিএম; পুনিয়া ব্রাদার্সের ফাইজা ক্রিমে ৫৯০.৪৫ পিপিএম; নূর গোল্ড কসমেটিকসের নূর ক্রিমে পারদ ১৯৩.৬৮ পিপিএম ও হাইড্রোকুইনোনের মাত্রা ১৯৮০.৬৮ পিপিএম; হোয়াইট পার্ল কসমেটিকসের হোয়াইট পার্ল প্লাস ব্র্যান্ডের স্কিন ক্রিমে পারদ ৯৪৮.৯৩ পিপিএম ও হাইড্রোকুইনোন ৪৩৪.৭৩ পিপিএম মাত্রায় পাওয়া গেছে।

বিএসটিআইর উপ-পরিচালক মো. রিয়াজুল হক বলেন, ‘পাকিস্তানি এই আটটি রং ফর্সাকারী ক্রিমের মধ্যে পারদ (মার্কারি) এবং পারদ ও হাইড্রোকুইনোনসহ অন্যান্য উপাদানে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর উপস্থিতি পাওয়া যায়। সেগুলো নিষিদ্ধ করেছে বিএসটিআই। এই ক্ষতিকারক পণ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণার পরে বাজারজাতের এখনো পর্যন্ত কোনো অনুমোদন দেয়নি বিএসটিআই।

সংগ্রহ করার সময় এসব পণ্যের মোড়কে কোনো আমদানিকারকের ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ফলে এগুলো শুল্কায়নের মাধ্যমে বৈধ পথে এসেছে নাকি অবৈধ পথে এসেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি বিএসটিআই। বিএসটিআইর ছাড়পত্র না নিয়ে এ ধরনের ক্রিম বাজারজাতকরণ সম্পূর্ণ বেআইনি।’

তিনি আরও জানান, এসব পণ্য আমদানি, খোলাবাজার কিংবা অনলাইনে বিপণনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (অতিরিক্ত পরিচালক) চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নাজমুল করিম মানিক মানবজমিনকে বলেন, এসব রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করে ত্বকে চুলকানি, প্রদাহ, জ্বালাপোড়া, ফুসকুড়ি এমনকি ত্বক স্থায়ীভাবে লাল হয়ে পুড়ে যেতে পারে?

রং ফর্সাকারী ক্রিমগুলো অনেক আগে থেকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে পার্লারগুলোতে বেশি করছে। কিন্তু কি ব্যবহার করছি এটা আমরা অনেকে বুঝতে পারি না। যদি কোন ক্ষতিকারক দ্রব্য বেশি থাকে তাহলে ত্বকের চামড়াটা পাতলা হয়ে যায়, মুখে পশম গজানোসহ অনেক ধরনের জটিলতা হতে পারে।

এসব ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারে ত্বক আরও বেশি কালচে হয়ে যায়। সূর্যের আলো পড়লে এই ক্রিম ব্যবহারকারী ত্বকে আরও বেশি ক্ষতি হয়। মার্কারি ত্বকের জন্য অনেক ক্ষতিকর। হাইড্রোকুইনোন সাময়িকের জন্য ত্বকের রং ফর্সা করে কিন্তু কিছুদিন না যেতে স্কিনের রং কালচে হয়ে পুড়ে যায়। এটি ত্বকের জন্য অনেক ক্ষতিকারক প্রভাব সৃষ্টি করে।

নিজেদের সচেতন হতে হবে। এই ক্রিমগুলো ব্যবহার ছেড়ে দিলে আবার বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মুখে সাময়িকের জন্য এ ধরনের কোনো ক্ষতিকারক দ্রব্য ব্যবহার করা উচিত নয়।

চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্বকের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ এ ধরনের ক্রিম। রং ফর্সাকারী এসব ক্রিম ব্যবহারে চর্ম রোগের ঝুঁকি বাড়ে। এই ক্রিমের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এগুলো ব্যবহারে অনেকের শরীরে এলার্জি হয়, লাল দানা ওঠে, চুলকায় এবং ফুলে যায়।

অনেক সময় ইনফেকশন হয়ে ক্ষত তৈরি করে। এমনকি যারা এসব ক্রিম তৈরি করেন তাদের উপাদানের পরিমাপ ও কোনটা কোন ত্বকে লাগালে উপকার হবে সে বিষেয়ে কোনো ধারণা থাকে না। রং ফর্সা করার পরিবর্তে এসব ক্রিম ব্যবহারের পর মুখে আরও বেশি দাগ দেখা যায়।

নিউমার্কেটের গাউছিয়া কসমেটিকসের বিক্রেতা বশির জানান, বাজারে কেউ অভিযানে আসে না। আমরা ওপেন বিক্রি করছি। ক্রেতাদের চাহিদা থাকায় আমরা বিক্রি করছি। প্যাকেটে কয়েক হাজার পিস আনা হয়। আবার অনেক পার্টি আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমাদের পাঠিয়ে দিচ্ছে। ভালো ইমপোর্টার ধরতে পারলে তারা অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এই ক্রিমগুলো আমাদের এনে দেন।

ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের সাইফা কসমেটিকসের বিক্রেতা জানান, এগুলো ইমপোর্টের পরিচিত লোকদের মাধ্যমে গোপনে আনা হয়। সরকার থেকে নিষিদ্ধ করার পরে কিছুদিন বিক্রি বন্ধ ছিল। এখন ক্রেতাদের এই ক্রিমগুলোর প্রতি চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমরাও বিক্রি করছি। বিক্রি অনেক ভালো হচ্ছে।

বসুন্ধরা লেভেল-১, জর্ডানা কসমেটিকস ইউএসএ শপিংমলের বিক্রেতা হোসাইন জানান, মাঝে এই ক্রিম বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। এখন আবার বিভিন্ন পার্টির মাধ্যমে এই ক্রিম সংগ্রহ করে বিক্রি করি।

বসুন্ধরার লেভেল-১, ব্লক-সি, দোকান নাম্বার-৩৯ বিক্রেতা এমডি সবুজ জানান, এই ক্রিমের প্রতি ক্রেতাদের চাহিদা বেশি। আমরাও বিক্রি করছি। তবে এই ক্রিমগুলো সরকার নিষিদ্ধ করেছিল।

নিউমার্কেটের নিউ রাফিন কর্ণারের রাফিন প্লাজার বিক্রেতা জানান, এগুলো বিক্রি করায় কোনো অভিযান এখনো হয়নি। এই পুরনো ক্রিমগুলোর প্রতি ক্রেতাদের অনেক চাহিদা। সবাই এসে চায়। এজন্য আমরাও বিক্রি করছি।

ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টের এন এম কসমেটিকস অ্যান্ড গিফটসের বিক্রেতা জানান, অনেক সময় বিভিন্ন পার্টি এসে আমাদের গোপনে দিয়ে যাচ্ছে এই ক্রিম। আমরাও বিক্রি করছি। কেউ তো কিছু বলছে না।

 

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!