মালয়েশিয়ায় ৪১৩৫ বাংলাদেশির অর্থ পাচার

  • আপডেট সময় সোমবার, মার্চ ৬, ২০২৩
  • 152 পাঠক

————–

ডেস্ক রিপোর্ট

————-
মালয়েশিয়ায় কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। মোট ৪ হাজার ১৩৫ জন বাংলাদেশি এই অর্থ দিয়ে দেশটিতে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন। সুইস ব্যাংকসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে তৈরি করা কর্মকৌশল-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

গত ৬ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার-সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্তসহ কৌশলপত্রটি গত ২ ফেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পাঠিয়েছে বিএফআইইউ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়ার ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম (এমএমটুএইচ)’ একটি বহুল আলোচিত অভিবাসন কর্মসূচি। চীন ও জাপানের পর বাংলাদেশি নাগরিকরা এমএমটুএইচ কর্মসূচির সবচেয়ে বড় গ্রাহক বা অংশীদার।

২০০৩ থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৪২ হাজার ২৭১ জন এই সুযোগ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৪ হাজার ১৩৫ জন (বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়)। এ প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য পঞ্চাশের নিচের বয়সের ব্যক্তির জন্য কমপক্ষে ৫ লাখ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা) এবং পঞ্চাশ বা তদূর্ধ্ব বয়সের জন্য কমপক্ষে সাড়ে ৩ লাখ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮৪ লাখ টাকা) তরল সম্পদ প্রদর্শন করতে হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জীবনযাপনের স্বস্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে এমএমটুএইচের মতো স্কিমে অংশগ্রহণকারীরা প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক অর্থ দেশটিতে নিয়ে গেছেন। যদি প্রত্যেক ব্যক্তির গড়ে ২ কোটি টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে শুধু এমএমটুএইচ কর্মসূচির মাধ্যমেই ২০০৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা মালয়েশিয়াতে স্থানান্তরিত হয়েছে, যার অধিকাংশই আয়কর বিভাগের কাছে অঘোষিত এবং কর অনারোপিত অর্থ।

এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, প্রতিজন ২ কোটি টাকা হিসাবে এই অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ২৭০ কোটি টাকা হওয়ার কথা। প্রতিবেদনে এটি ভুল হিসাব করা হয়েছে।

এমএমটুএইচ প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সাল শেষে প্রকল্পটিতে মোট বিনিয়োগকারী ৪৮ হাজার ৪৭১ জন। এক্ষেত্রেও তৃতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী হিসেবে আছেন বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা। সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী চীনের ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ, জাপানের ১১ দশমিক ৩, বাংলাদেশের ৯ দশমিক ৮, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ৪, কোরিয়ার ৫ দশমিক ৬, সিঙ্গাপুরের সাড়ে ৩ শতাংশ, ইরান ও তাইওয়ানের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ করে, হংকংয়ের ২ দশমিক ৬, ভারতের আড়াই শতাংশ এবং অন্যান্য দেশের ২১ দশমিক ৩ শতাংশ।

পেনাং ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এমএমটুএইচ প্রকল্পের মোট বিনিয়োগের ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশিরা। এ ছাড়া ২০০৪ সালে ১১ শতাংশ, ২০০৬ সালে ২০, ২০০৭ সালে ১০, ২০০৯ সালে ৫, ২০১১ সালে ১২, ২০১২ সালে ১২, ২০১৩ সালে ৮, ২০১৪ সালে ৮, ২০১৫ সালে ৯, ২০১৬ সালে ৮, ২০১৭ সালে ৭ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছিল। অন্যান্য বছরে বিনিয়োগ হলেও তা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ের নয়।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এ অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ এটা মালয়েশিয়াতে বৈধ বিনিয়োগ। এই টাকা উদ্ধারে আগে প্রমাণ করতে হবে যে এগুলো মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, যা অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ কাজ। এই অর্থ উদ্ধারের আগে ভাবতে হবে কেন এমন ক্যাপিটাল ফ্লাইট হচ্ছে। প্রথমত, অবৈধ উপার্জন। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। আমাদের এগুলো বন্ধ করার ওপর জোর দিতে হবে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, মূলত এসব টাকা অনৈতিক বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত। এসব টাকা উদ্ধারে আগে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আইনি সহায়তা (লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স) চুক্তি করতে হবে। এতে সুনির্দিষ্ট তথ্যও যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি ওই দেশের আদালতে মামলাও করার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যাবে।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনের সুপারিশেও পাচারকৃত অর্থের গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদের দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং-চীন, থাইল্যান্ড থেকে পারস্পরিক আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তির জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি আইনগত সহায়তাপ্রাপ্তি সহজীকরণের জন্য গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

চুক্তির মধ্যে তথ্য সংগ্রহ, সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, জিজ্ঞাসাবাদ ও বক্তব্য গ্রহণ, নোটিস ও আদেশ জারি, জব্দ, আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথ তদন্ত, সম্পদ চিহ্নিত করা, অনুসন্ধান, সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও অপরাধলব্ধ সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিষয়গুলো উল্লেখ থাকতে হবে। বৈঠকে এ চুক্তির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

ওই সভায় আরও জানানো হয়, বিএফআইইউকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় মোট ৩৪৭টি গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে এবং সেখান থেকে এ পর্যন্ত ২১২টি মামলা করা হয়েছে। এই সময়ে বিদেশি এফআইইউর কাছে ৫১৬টি অনুরোধ পাঠানো হয়েছে এবং বিদেশি এফআইইউ ১২৮টি অনুরোধ করেছে। অপরদিকে আইন, বিধিমালা ও নির্দেশনার ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে জরিমানা করা হয়েছে।

সভায় অর্থমন্ত্রী পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে সবাইকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি এর জন্যে প্রয়োজনে আইন সংশোধন, লিগ্যাল বা প্রফেশনাল ফার্ম নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও বলেন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!