অধিক গতি সম্পন্ন বাইক মানেই মৃত্যু

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ২৪, ২০২৪
  • 35 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২৩ অক্টোবর, ২০২৪

শেরপুরের শ্রীবরদীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবুজ মিয়া (২২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এতে মাহমুদুল হাসান জয় (২৬) নামের আরেক যুবক আহত হয়েছেন বলে জানা যায়। মঙ্গলবার পৌর শহর থেকে দহেড়পাড় সড়কের শ্মশানঘাট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

মাদারীপুর জেলার শিবচরে পদ্মা সেতুর হাইওয়ের ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্থ শীল (২০) ও অয়ন (২০) নামে দুই কলেজ বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় আহত আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

সিলেটের গোলাপগঞ্জে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত মাহবুব আহমদ (২৬) নামের যুবকের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে সিলেটের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার চৌবাড়ি গ্রামে মটোর সাইকেল দূর্ঘটনায় ২ কলেজ ছাত্র নিহত হয়েছে। নিহতরা হলো- ওই গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে কলেজ ছাত্র সোহাগ রানা (১৭) ও বেলকুচি উপজেলার আদাচাকী গ্রামের হাসান আলীর ছেলে কলেজ ছাত্র খালিদ হাসান (১৭)। এ ঘটনায় আরো ১ জন গুরুতর আহত হয়েছে।

মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার এসব খবর প্রতিবেদন লেখা থেকে ধরে, গত ২৪ ঘণ্টার। সড়কে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বছরে অন্তত কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন ভয়াবহ এসব দুর্ঘটনায়। প্রাণহানি ছাড়াও চিরতরে পঙ্গু হচ্ছেন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ। আর এসব দুর্ঘটনার মধ্যে সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায়।

প্রতিনিয়তই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে বেসরকারি সংস্থা- রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে। সংস্থাটির দাবি, গত পাঁচ বছরে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার বেড়েছে ১৬ শতাংশ। আর এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হার বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।

মহাসড়কে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করছেন আরোহীরা। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটর সাইকেল ব্যবহৃত হয়, এমন ১৬টি দেশের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটর সাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. মাহবুব আলম তালুকদারের মতে, দেশে মোটর সাইকেলের উৎপাদন ও আমদানি আগের থেকে অনেক বেড়েছে। ফলে কম টাকায় মোটর সাইকেল কিনতে পাওয়া যায়, এমনকি লোনে ও কিস্তিতেও পাওয়া যায়। ফলে মানুষ সামান্য টাকা হলেই এটা কিনতে পারছে। কিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে, সেটা কেউ চিন্তা করছে না।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন অদক্ষ চালক সড়কে থাকা মানে অন্তত ৫-৬ জন মানুষ ঝুঁকিতে থাকা। বিআরটিএ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটর সাইকেলের সংখ্যা ৩৬ লাখের বেশি। কিন্তু মোটর সাইকেল চালানোর লাইসেন্স রয়েছে ২৩ লাখের মতো। অর্থাৎ ১৩ লাখের বেশি মোটর সাইকেল চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় ১৫ লাখের বেশি মোটর সাইকেল রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশের নিবন্ধনও নেই। এদিকে ঈদসহ বিভিন্ন বড় ছুটিতে মহাসড়কে মোটর সাইকেলের উপস্থিতি বেড়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, গত ঈদে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জনের মৃত্যু হয়। আর নিহতদের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটর সাইকেলের চালক ও আরোহী।

সর্বশেষ অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৫৯৮ জনের, আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০১ জন।

দেখা গেছে, এই ৯ মাসে ২ হাজার ৪১টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন ১ হাজার ৯২৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৪.৩৬ শতাংশ। সে হিসেবে প্রায় ৮০ শতাংশ মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় একজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এবং মোট নিহতের দিক থেকে সব থেকে বেশি।

এ ছাড়া দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১২১ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের প্রায় ২০ শতাংশ। নিহতের মধ্যে নারী ৬৭৭ ও শিশু ৭২৯ জন। এ ছাড়া যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৮ জন, যা মোট নিহতের ১২.২৯ শতাংশ। নিহতের মধ্যে বাসযাত্রী ছিলেন ২৯৩ জন বা ৫.২৩ শতাংশ, এবং ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-লরি ইত্যাদি পণ্যবাহী যানবাহনের আরোহী মারা গেছেন ৪২০ জন।

এ ছাড়া দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে এসব পণ্যবাহী যানবাহনের সম্পৃক্ততার হার ২৩.১৪ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে তা ১০.২৫ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৪.৭৬ শতাংশ এবং থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান ইত্যাদি) ১৬.৪৯ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার বেশিরভাগ বা ৩৩.৭১ শতাংশ ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে, আঞ্চলিক সড়কে এই হার ৩৮.০৯ এবং গ্রামীণ সড়কে ১৪.০৫ শতাংশ এবং শহরের সড়কে ১২.২১ শতাংশ।

যত গতি, তত ক্ষতি

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান ভ্যেস অফ আমেরিকার সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছিলেন, তাদের হিসাব অনুযায়ী গত এপ্রিলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৬ জন মারা গেছেন। তিনি বলেন, “ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ৩৬ লাখ বা তার বেশি মোটরসাইকেল আছে। এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। এর মধ্যে (মোটরসাইকেল চালকের) ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা আছে ২৩ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ১৩ লাখ চালকের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি। এর বাইরেও অসংখ্য মোটরসাইকেল আছে। চালকদের বড় একটি অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর এবং তরুণ। এই কিশোরদের বেশির ভাগ অত্যন্ত বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। বেপরোয়া গতির এই যে প্রবণতা, এটি আইনি কাঠামোর মধ্যে দিয়ে বন্ধ এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পারিবারিক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কিছু সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করা যেতে পারে। গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি যে সড়ক পরিবহন আইন আছে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।”

অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য অতিরিক্ত গতির কথা বললেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই)পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানও। পাশাপাশি তিনি “ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ’ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন।

তার ভাষায়, ‘‘ প্রথম কথা হচ্ছে গতিসীমা। এ কথা আমরা বারবার বলি। গতিসীমার মধ্যে বাইক চালাতে হবে। গতিসীমার কথা যখন বলছি, সাথে সাথে এটাও বোঝাচ্ছি যে, আমাদের দেশে কেউ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোটরসাইকেল চালানো শেখেন না। হয়তোবা বন্ধুর একটা মোটরসাইকেল নিয়ে শিখেছেন। আপনি যদি পেশাদার প্রশিক্ষকের কাছে না শেখেন, তাহলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। সড়ক পরিবহনসংক্রান্ত যে আইনগুলো আছে—ট্রাফিক সাইন, মার্কিংয়ের মানে কী বা সিগন্যালে কী করতে হবে, এই বিষয়গুলো আমরা শিখছি না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো না শিখলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাচ্ছে। এই অজানা অবস্থায় কোনোমতে চালানো শিখে আমরা সড়ক-মহাসড়কে নেমে যাচ্ছি। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দিন-দিন বাড়ছে।”

বাংলাদেশের চালকেরা যে ধরনের হেলমেট ব্যবহার করেন তার সুরক্ষা ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হেলমেটের এই গুণগত মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‘ আমাদের গবেষণায় দেখেছি, হেলমেটের বিষয়টি যেভাবে বিবেচনায় নেয়া উচিত, এখনো সেভাবে পারিনি। ঢাকা থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে হেলমেট পরিধানের সংখ্যা বেড়েছে-এটা নিয়ে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগি। কিন্তু গুণগত মান নিয়ে ভাবছি না। দুর্ঘটনার পরে আমরা দেখি অনেকেরই হেড ইনজুরি আছে। এতে দ্রুত মৃত্যু হয়। এখানে বিএসটিআইয়ের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের হেলমেট টেস্টিং ল্যাব দরকার।”

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!