দিল্লির আশীর্বাদ পেতে কি দিয়েছিলেন হাসিনা ?

  • আপডেট সময় রবিবার, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫
  • 55 পাঠক

ভিন্ন দৈনিক। ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

‘ ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি তারা সারাজীবন মনে রাখবে ’ উক্তিটি শেখ হাসিনার। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে তিনি পালিয়ে আশ্রয় নেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। বর্তমানে তিনি দিল্লির সমর্থনে দেশবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তার হাতে লেগে আছে হাজারো ছাত্র-জনতার রক্ত।

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার উপর্যুক্ত উক্তির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অঙ্গন, কূটনৈতিক মহল ও প্রশাসনসহ জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে—আশীর্বাদ পেতে শেখ হাসিনা ভারতকে কী কী দিয়েছেন ?

অনুসন্ধান বলছে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার ভারতের সঙ্গে অন্তত ২০টি চুক্তি ও ৬৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকের অধিকাংশই একতরফাভাবে ভারতের স্বার্থরক্ষা করে সম্পাদিত হয়েছে। ফলে চুক্তিগুলো পর্যালোচনার দাবি করেছেন দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা।

সীমান্তে অবৈধ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে গোপন চার চুক্তি

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার মধ্যে তিন হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকাতেই ভারত অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া তৈরির কাজ শেষ করেছে। ভারত অত্যন্ত গোপনে ২০১০ সালে শুরু করে ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ বেড়া নির্মাণের কাজ করে।

সীমান্ত ইস্যুতে ভারতকে অন্যায্য সুবিধা দিয়ে শেখ হাসিনা চারটি চুক্তি করেছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গত কয়েক মাস ভারত চুপ থেকে অবশিষ্ট ৮৮৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে। বিজিবি বাধা দিতে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) শেখ হাসিনার আমলের চুক্তিগুলোর রেফারেন্স দিচ্ছে।

সীমান্ত ইস্যুতে গোপন এ চুক্তিগুলোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সীমান্তে শূন্য রেখার ভেতরে অবৈধভাবে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য ২০১০ সালে শেখ হাসিনা ভারতের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে ভারত ও বাংলাদেশ এ বিষয়ে চারটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। অসম এসব চুক্তি বাতিল করার জন্য আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

————————————————————————————————

উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম-সীমান্ত নির্দেশাবলি-১৯৭৫ অনুযায়ী, উভয় দেশের শূন্য রেখার ১৫০ গজের মধ্যে প্রতিরক্ষা সংবলিত যে কোনো কাজ সম্পন্নের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া উভয় দেশের প্রয়োজনে শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে যে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করার ক্ষেত্রে একে অপরের সম্মতি নেয়ার বাধ্য-বাধকতা রয়েছে।

————————————————————————————————

২০১০ সালের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে তিন হাজার ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় ভারত সব নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। এখন বাকি ৮৮৫ কিলোমিটার এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে ভারত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এটা কোনোভাবে করতে দেব না। প্রতিনিয়ত প্রতিটি এলাকা আমরা নজরদারিতে রেখেছি।

ভারত একতরফা ট্রানজিট পেলেও বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়নি

বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত ১/১১ সরকারের হাত ধরে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় আসে। সে সময়ের সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে মুখে ছিল ভারতকে ট্রানজিট দিলে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাইয়ের মতো হয়ে ওঠবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো। সরকারের কেউ কেউ তখন বাংলাদেশ ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর মতো হবে বলেও প্রচার করে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশ প্রথম নৌ-ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে। এর আগে নৌ-মন্ত্রণালয় চুক্তির খসড়া পর্যালোচনা করে মতামত চেয়ে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আইন মন্ত্রণালয় নেতিবাচক মতামত দিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণসহ তিন দফায় চুক্তির খসড়াটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ফেরত পাঠিয়ে দেয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ সূত্র বলছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিনিময়ে কোনো ধরনের শুল্ক বা ট্যারিফ আরোপের বিষয়টি চুক্তির খসড়ায় উল্লেখ করেনি। শেষ পর্যন্ত চতুর্থ দফায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনায় আইন মন্ত্রণালয় ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার চুক্তির পক্ষে মত দিতে বাধ্য হয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের চুক্তির আওতায় ২০১৫ সালে ভারতের সঙ্গে আরও একটি প্রটোকল সই হয়। এ প্রটোকলের মাধ্যমে ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। এতে করে ভারতের কলকাতা ও মুর্শিদাবাদকে বাংলাদেশের পূর্বে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার সুযোগ পায়।

পর্যায়ক্রমে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে সড়ক ও রেল ট্রানজিটও আদায় করে নিয়েছে। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্যগুলো বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও জলপথে আখাউড়া-আশুগঞ্জ ও আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্থল ও জলভাগ ব্যবহার করে নৌ, সড়ক ও রেলপথে ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য পরিবহনের বিনিময়ে কী পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ সরকার পেয়েছে তার সঠিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

————————————————————————————————

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারতকে ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়নি কেন—এমন প্রশ্ন ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। জবাব দেয়ার জন্য তিনি দুদিন সময় নেন। তৃতীয় দিনে ওই কর্মকর্তা জানান, আসলে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের বিনিময়ে আমরা ভারতের কাছ থেকে কী পরমাণ অর্থ পেয়েছি, তার হিসাব করা হচ্ছে। ট্রানজিট চুক্তির পর প্রায় ১৪ বছর পার হতে চলেছে। দেশটি যেহেতু সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত হয়নি, তাই শুল্ক ও ট্যারিফ বাবদ কিছু পেয়েছি, তা বলা যাবে না।

————————————————————————————————

ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিষয়ে ওই সময় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রবল আপত্তি জানায়। সিলেটে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নেতৃত্বে ট্রানজিটবিরোধী তীব্র আন্দোলন হয়। আশুগঞ্জ নদীবন্দর অভিমুখে ঢাকা থেকে লংমার্চও হয়। এর পরই ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলী গুমের শিকার হন। রাজনৈতিক মহলের দাবি ভারতকে একতরফা ট্রানজিট দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় ওই সময় দুই দেশের সরকারের টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের অনুমতি

ট্রানজিট আদায় করে নেয়ার পর ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের সুবিধা পায়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রটোকল সই হয়। এ প্রটোকলের আওতায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে পৌঁছানো পণ্যসমূহ বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে সড়ক, রেল ও জলপথে আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরা, তামাবিল হয়ে মেঘালয় ও সুতারকান্দি হয়ে আসামে এবং বিবিরবাজার হয়ে সীমান্তপুরে (আসাম) আনা-নেয়া করতে পারবে।

২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল ভারতে চট্টগ্রাম ও মোংলাবন্দর ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমতি দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করে।

এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘ অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস ফ্রম ইন্ডিয়া ’-এর আওতায় উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট পণ্যের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এ আদেশ জারি করা হয়। ফলে ভারত বন্দর দুটি ব্যবহার করে নিজ দেশে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। চট্টগ্রাম-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা-আখাউড়া-আগরতলা, তামাবিল-ডাউকি, শেওলা-সুতারকান্দি ও বিবিরবাজার-সীমান্তপুর রুটে ১৬টি ট্রানজিট রুট খোলা হয়েছে।

তিস্তার ন্যায্য হিস্যা চেয়ে দিতে হলো ফেনী নদীর পানি

আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী তিস্তার উজানে গজলডোবাসহ কয়েকটি স্থানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে চলছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ থাকে একেবারেই তলানিতে। ফলে বাংলাদেশের গোটা উত্তরাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।

বাংলাদেশ ১৯৮৩ সাল থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের চেষ্টা করে আসছে। ভারতও একের পর এক প্রতিশ্রুতি দিয়ে পানিবণ্টন চুক্তি করছে না। উল্টো আন্তর্জাতিক নদীশাসন আইন লঙ্ঘন করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

————————————————————————————————

২০১৯ সালের অক্টোবরে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে এমন অঙ্গীকার করে উভয় দেশ। সফরে দুই শীর্ষনেতার বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে তিস্তাচুক্তির খসড়া তো দূরের কথা আন্তর্জাতিক এ নদীর পানির প্রবাহের কথাটিই ওঠেনি। উল্টো বাংলাদেশের নিজস্ব নদী ফেনীর পানি চেয়ে বসে ভারত। বৈঠকে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদির আবদার ফেলতে পারেননি। দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ভারতকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

————————————————————————————————

এ চুক্তির আগে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভার অনুমোদন নেননি বলে অভিযোগ ওঠে। পানি বিশেষজ্ঞরাসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন এ চুক্তির তীব্র সমালোচনা করে।

এ চুক্তির পর দেশে ফিরে শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলন করে সমালোচনার জবাব দেন। ভারতকে ফেনী নদীর পানি দেওয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ত্রিপুরার মানুষকে কিছু পানি খাওয়ার জন্য দিচ্ছি। এ বিশাল নদীর কিছু পানি ভারতকে দেয়ার ফলে এত চিৎকার করা হচ্ছে কেন ? ভারত পান করার জন্য কিছু পানি চেয়েছে, আমরা দিয়েছি। এটা নিয়ে কিছু মানুষ খুব সমালোচনা করছে ও লেখালেখি করছে। আর বিএনপি তো সমালোচনা করেই চলেছে। তারা এটা নিয়ে সমালোচনা করছে কোন মুখে ?’

বাংলাদেশ ছিল ভারতের উন্মুক্ত বাজার

২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৭১৬০ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার। এমন বাণিজ্যঘাটতি বিশ্বে বিরল ঘটনা বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ ভারতের একটি উম্মুক্ত বাজারে পরিণত হয়েছিল গত ১৫ বছরে।

দেশের চাহিদা অনুযায়ী, অনেক পণ্যই আমদানি করতে হয়। কিন্তু বিকল্প বাজার না খুঁজে সবকিছুই ভারত থেকে কিংবা ভারতের মাধ্যমে আমদানি করা শেখ হাসিনার একটি প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলেও জানান অর্থনীতিবিদরা।

————————————————————————————————

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর স্থলপথে দুই দেশের মধ্যে এক কোটি ৬০ লাখ ২৮ হাজার ৮০০ টন পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হয় এক কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৩ টন। এ সময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৮ টন পণ্য। অর্থাৎ প্রায় ৯৪ শতাংশই ভারতের অনুকূলে।

————————————————————————————————

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারত তাদের ৩৬০টি পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পয় ১৩৫টি পণ্যে। অন্যদিকে কাগজ-কলমে বাংলাদেশ ৩৬টি পণ্য রপ্তানির সুবিধা পেলেও বাস্তবে হাতেগোনা কয়েকটি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

মাসে ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি করে আদানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি

দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৪৪ মেগাওয়াট। এ তথ্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা বেশি হওয়ার পরও ভারত থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে শেখ হাসিনার সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালে তার নয়াদিল্লি সফরের সময় ভারতের আদানি পাওয়ারের সঙ্গে চূড়ান্ত বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত গৌতম আদানি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের একজন। তিনি আদানি পাওয়ারের মালিক। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রথম ঢাকা সফরের সময় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে প্রথম চুক্তি হয়।

দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভারতের আদানির সঙ্গে সম্পাদিত এ চু্ক্তি দেশের স্বার্থে নয়, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আদানির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন বারবার দাবি করলেও চুক্তিটি প্রকাশ করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে আমার দেশের হাতে ১৫৮ পৃষ্ঠার অসম এ চুক্তির কপি রয়েছে।

চুক্তির বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় অতিরিক্ত ৭০০ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিদ্যুৎ আমদানির কয়েকটি অসংগতি তুলে ধরে তিনি বলেন, চুক্তিতে যে ট্যারিফের কথা বলা হয়েছে, তা আমাদের স্থানীয় কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ক্রয়মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ২৫ বছরে ভারতের আদানি পাওয়ারকে বাংলাদেশের প্রায় ২৩ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার দিতে হবে, যা বর্তমানে দেশের সমুদয় রিজার্ভের চেয়েও বেশি।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারতের আদানি পাওয়ারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত ১১টি চুক্তি খতিয়ে দেখতে ‘ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তি পর্যালোচনা ’ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ইতিমধ্যেই ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কিত সব নথিপত্র তলব করেছে।

বাংলাদেশের আশীর্বাদপুষ্ট ভারতের রেমিট্যান্স

বাংলাদেশে লাখো বেকার চাকরির জন্য ঘুরছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণরা ভালো চাকরি প্রত্যাশায় অবৈধভাবে ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারাচ্ছেন। কেউ আবার লিবিয়ার কারাগারে কিংবা থাইল্যান্ডের গহিন জঙ্গলে অরণ্যরোধন করে চলেছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ভারতের কয়েক লাখ মানুষ বৈধ ও অবৈধভাবে চাকরি করছেন। ভারতে রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের নামও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে কর্মরত বিদেশিরা ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ নিজ দেশে পাঠিয়েছেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৫০ লাখ ডলারে। আর এই টাকা পাঠানোর দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ভারতীয়রা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব বলছে, গত অর্থবছরে চার কোটি ৪০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স গেছে ভারতে, যা দেশের বাইরে যাওয়া রেমিট্যান্সের মধ্যে সর্বোচ্চ।

পাঠ্যপুস্তক বাংলাদেশের, ছাপানো হতো ভারতে

প্রতি বছর দেশের স্কুল, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক পর্যায়ের এক কোটি ৮৯ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য ২৩ কোটির বেশি কপি বইয়ের প্রয়োজন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এসব পাঠ্য বইয়ের জোগান দেয়। এনসিবিটির বই ছাপানোকে কেন্দ্র করে দেশে একটি বিশাল প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠে।

এ শিল্পের সঙ্গে দেশের কয়েক লাখ মানুষ যুক্ত হয়। কাগজ আমদানি, ছাপাখানা তৈরি, বই ছাপানো, বাঁধাই ও সরবরাহের কাজে সরগরম থাকত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীদের এসব পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর দায়িত্ব ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়।

শেখ হাসিনার আমলে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ করায় প্রথম দিকে ব্যাপক আন্দোলন করে দেশের ছাপাখানার মালিক ও কর্মীরা।

আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী বছরের জন্য প্রাথমিকের প্রায় এক কোটি পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পায় ভারতীয় প্রিতম্বর বুকস প্রাইভেট লিমিটেড ও পাইওনিয়ার প্রিন্টার্স নামের দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। দেশের প্রকাশকদের বাদ দিয়ে ভারতীয় প্রকাশকদের বই ছাপাতে দেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই।

ব্যাপক সমালোচনার পর গত ২৮ অক্টোবর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে দেয়া বই ছাপানোর কার্যাদেশ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ভারতের কব্জা থেকে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ বাংলাদেশে পুরোপুরিভাবে ফিরে আসায় দেশের প্রকাশনা শিল্প ফের সরগরম হয়ে ওঠবে বলে আশা করছেন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক

২০১৪ সালে শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর পরই ভারতের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির উদ্যোগ নেন। এ ধরনের একটি চুক্তি হলে বাংলাদেশ সিকিম ও হায়দারাবাদের মতোই স্বাধীনতা হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিভিন্ন মহলের আপত্তি ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনা অত্যন্ত গোপনে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সমঝোতা স্মারক সই করেন। ২০১৮ সালের ১২ মে একটি গণমাধ্যম এ তথ্য প্রকাশ করে।

এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারকে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে যে ৫০০ মিলিয়ন ঋণ দিয়েছে, কীভাবে সেই অর্থ ব্যয় হবে তার রূপরেখা ঠিক করতে তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয় দুই দেশের মধ্যে। ঋণের অর্থ কীভাবে খরচ হবে, কোন কোন প্রতিরক্ষাসামগ্রী কেনাবেচা হবে, সহযোগিতার ক্ষেত্র কোথায় কীভাবে বাড়ানো হবে সেটা উল্লেখ করা হয় সমঝোতা স্মারকে।

এ ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের প্রয়োজনভিত্তিক চাহিদাপত্র ভারতকে দেবে, তা পাওয়ার পর ঠিক হবে ভারত কী কী সরবরাহ করতে পারে।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়চুক্তি

আগের সমঝোতা স্মারকের সূত্র ধরে ভারতের সঙ্গে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনে এ চুক্তি করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। চুক্তির পর ২০২২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব বিনয় মোহন কাত্রা সাংবাদিকদের সামনে তা প্রকাশ করেন।

৫০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিটির বিষয়ে বিনয় মোহন কোয়াত্রা সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রতিরক্ষা এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) অধীনে প্রথম চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রতিরক্ষা এলওসি হলেও এটি উন্নয়ন অংশীদারত্ব কাঠামোর একটি অংশ। নিরাপত্তা ও কৌশলগত সহযোগিতার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে। এই প্রচেষ্টা প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুই দেশের পারস্পরিক অংশগ্রহণ আরও উন্মুক্ত করবে।

ভারতকে রেল করিডোর প্রদান

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো থেকে পণ্য ও মালামাল আনার-নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয় ভারতকে। মাঝখানে বাংলাদেশ থাকায় দেশের অন্য অংশের সঙ্গে রাজ্যগুলোর পণ্য পরিবহন বেশ ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। সেই কারণেই বাংলাদেশের কাছে পণ্য ট্রানজিট সুবিধা চেয়ে আসছিল ভারত।

ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে পলায়নের মাত্র দুই মাস আগে দেশটিতে যান শেখ হাসিনা। ওই সফরটিই ছিল শেখ হাসিনার শেষ আনুষ্ঠানিক সফর। এ সফরে তিনি ভারতকে রেল ট্রানজিট দিতে সম্মতি জানিয়ে আসেন। এটিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন ‘গোলামির চুক্তি’হিসেবে চিহ্নিত করে তীব্র সমালোচনা করে। তারা চুক্তিটি প্রকাশ করারও দাবি জানান। ভারতকে একতরফা রেল ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম বিশ্লেষণধর্মী সংবাদ প্রকাশ করে।

রেল ট্রানজিট চুক্তির পর শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করা হলেও ভারতের ওই সময়ের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সাংবাদিদের জানান, এ ট্রানজিট চালু হলে নিজ দেশের মধ্যে রেলপথে দূরত্ব অনেকখানি কমবে ভারতের।

ভারতের স্বার্থরক্ষায় রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্যমতে, ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সেই দেশের ছত্তিশগড়ে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করায় ভারত সরকার এ প্রকল্পটি সে দেশের পরিবর্তে বাংলাদেশে করার প্রস্তাব করে।

২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের একটি প্রস্তাব ছিল।

এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১২ সালে সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে দুটি ৬৬০ ইউনিট মিলে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর কোনো রকম রূপ পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ না করেই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের আদেশ জারি করা হয় এবং অবকাঠামো উন্নয়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়।

————————————————————————————————

তীব্র সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে ২০২২ সালের শেষদিকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু করা হলেও কারিগরি ত্রুটি, কয়লা-সংকট ও অন্যান্য কারণে এখন পর্যন্ত মোট সাতবার বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি মূলত ভারতের আবদার রক্ষার জন্যই করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য কখনোই লাভজনক হবে না। এটি দেশের জন্য একটি বিশাল বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়।

————————————————————————————————

এদিকে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর আগে সরেজরিমনে দেখা গেছে, এটির নির্মাণশ্রমিক থেকে শুরু করে কারিগরি কাজে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ভারতের নাগরিক। খুব সামান্যসংখ্যক ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক। ভারতীয় নাগরিকদের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রয়োজনের ব্যবহৃত সবকিছুই তারা ভারত থেকে আমদানি করেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

ভারতীয়দের দখলে তুলে দেওয়া হয় বাংলাদেশের আইটি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ভারতের একচেটিয়া প্রাধান্য রয়েছে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের আইটি খাতে এখন ভারতীয় নাগরিকদের রাজত্ব চলছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিভিন্ন গণমাধ্যম। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, এসব খাতে এখন প্রায় পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক কাজ করছে। এর মধ্যে শতকরা মাত্র ১০ ভাগ বৈধভাবে। বাকি ৯০ ভাগই অবৈধভাবে কাজ করছে। পোশাকের বায়িং হাউসগুলোও নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা।

ভারতকে তিস্তা প্রকল্প দেয়ার পরিকল্পনা

ভারত তিস্তা নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে বাংলাদেশ উত্তরাঞ্চল দিন দিন মরুময় হচ্ছে। এতে কৃষিফলন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যই বাংলাদেশ তিস্তা মহাপ্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। চীন এ প্রকল্পে অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। অথচ চলতি বছরে শেখ হাসিনা ভারত সফর করে দেশে ফিরে হঠাৎ করেই তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে উল্টো কথা বলা শুরু করেন। তিনি তিস্তা প্রকল্প ভারতকে দিয়ে করাবেন বলে ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনা এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ তিস্তা প্রকল্প আমাদের করতে হবে। এ নিয়ে চীন-ভারত দুই দেশই আমাদের প্রস্তাব দিয়েছিল।

এরই মধ্যে চীন সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। আমি এখানে বেশি প্রাধান্য দেব যে, এটা ইন্ডিয়া করুক। কারণ তিস্তার পানিটা ইন্ডিয়া আটকে রেখেছে। তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের আদায় করতে হয়, তাহলে এ প্রজেক্টের কাজ তাদেরই করা উচিত। তারা প্রজেক্ট করে যখন যে প্রয়োজন তারা দেবে।

বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অবাধ সম্প্রচার

বাংলাদেশ ও ভারত অকৃত্রিম বন্ধুত্বের সব সীমা অতিক্রম করেছে বলে প্রতিনিয়ত বলতেন শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা। যদিও বহু চেষ্টার পরও ভারতে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার চালু করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের ১০০টিরও বেশি টিভি চ্যানেল সম্প্রচার চালিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে শতকোটি টাকার বিজ্ঞাপন ব্যবসাও ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই নিয়ন্ত্রণ করেছে।

তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভারতের জি ও স্টার গ্রুপের দুটি চ্যানেল জি বাংলা ও স্টার জলসা বাংলাদেশে মাত্র তিন লাখ টাকায় ডাউনলিংক করে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন নিয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের হিসাবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন পেয়েছে এ দুটি চ্যানেল। অথচ বাংলাদেশ ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত থেকে সরে আসেন শেখ হাসিনা

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৬ ঘণ্টায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালকসহ (ডিজি) দেশের মেধাবী ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের সীমান্তকে অরক্ষিত করে তোলা। আর এ ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রকাশ্যভাবে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। এ কারণেই এ ঘটনার আর আন্তর্জাতিক কোনো তদন্ত হয়নি বলেও ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের অভিযোগ।

————————————————————————————————

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদও তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে সাবেক এ সেনাপ্রধান বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনার আমি যখন তদন্তের আদেশ দিই, তখন আমাকে বলা হয় যখন সরকার এ বিষয়ে তদন্ত করছে, তখন আমাদের তদন্ত করার প্রয়োজন কী ? এ তদন্ত করতে ওই সময় সরকারের কাছ থেকে যে সাহায্য প্রয়োজন তা আমরা পাইনি।

————————————————————————————————

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতকে সরাসরি দায়ী করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম, যিনি বিডিআর হত্যকাণ্ডের পর পরই বিজিবি মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে শেখ হাসিনার নতজানু নীতি

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৫ বছরে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশি নাগরিককে সীমান্তে গুলি করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। বাংলাদেশ কখনোই এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি। বরাবরই শেখ হাসিনার সরকার নতজানু নীতি অনুসরণ করে চলেছে। ফেলানীকে গুলি করে হত্যার পর তার লাশ কাঁটাতারের বেড়ার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছে।

————————————————————————————————

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর ২২ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) যশোরের শার্শা উপজেলার ধান্যখোলা সীমান্তে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিজিবি সদস্যকে গুলি করে হত্যার পর লাশ ভারতে নিয়ে যায়। দু’দিন পর ভারত বিজিবি সদস্যের লাশ ফেরত দেয়। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতরে ঢুকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন সদস্যকে হত্যা করে লাশ নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় দেশের মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মালেও চুপ ছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

————————————————————————————————

পরে সচিবালয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে এ বিষয়ে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আপনারা আমার কাছে এমন একটি প্রশ্ন করেছেন সেটাও মিডিয়াতে আনবেন না। এ বিষয়টি পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখভাল করছেন।

বিষয়টি নিয়ে ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছেও প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা। জবাবে হাছান মাহমুদ বলেছেন, এমন কোনো ঘটনা আমি এখনো শুনিনি। আগে জেনে পরে আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেব।

অন্য দেশে যেতেও ভারতের অনুমতি নিতেন শেখ হাসিনা

ক্ষমতায় আসতে ও টিকে থাকতে ভারতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল বর্জন করায় বিপাকে পড়ে যায় ভারত ও আওয়ামী লীগ। ওই সময় ভারতে পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফর করে এইচ এম এরশাদকে ভোটারবিহীন নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেন।

ওই সময় প্রকাশ্যেই এ ঘটনা ঘটে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই বলেছেন, আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বলে এসেছি, তারা যেন শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করে। রাজনীতির মাঠে ড. মোমেনের এ বক্তব্য বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।

ওই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর শেখ হাসিনা চীন সফরে যান। এ সফর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের কাছ জানতে চাইলে গত ৩ জুলাই সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) এ চীন সফরে ভারতের আপত্তি নেই। তিনি ভারত সফরের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে চীন সফরের বিষয়টি জানিয়েছিলেন।

ভারতে সঙ্গে করা সব চুক্তি পর্যালোচনার দাবি রাজনৈতিক দলগুলোর

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের অব্যাহত অপপ্রচার ও জাতীয়- আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত ৪ ডিসেম্বর দেশের সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ভারতের সঙ্গে গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে করা সব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক যাচাই-বাছাই করার পরামর্শ দেন। তারা ক্ষতিকর চুক্তিগুলো বাতিলেরও প্রস্তাব দেন।

————————————————————————————————

এ বিষয়ে ওই দিন রাতে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ক্ষতিকর যেসব চুক্তি রয়েছে সেগুলো বাতিল করার দাবি জানিয়েছে দেশের সব রাজনৈতিক দল। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা—সেটার নিন্দা জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি মর্যাদাশীল ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

————————————————————————————————

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!