রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি-অনিয়ম

  • আপডেট সময় বুধবার, জুন ২৩, ২০২১
  • 801 পাঠক
————-
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন, তারা জনগণের সেবক। কারণ জনগণের ট্যাক্সের অর্থে তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়। জনস্বার্থে কার্য সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের কিছু ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই ক্ষমতা একধরনের দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তা এই দায়িত্বশীলতাকে প্রশ্নাতীত ক্ষমতা বলে মনে করেন। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যেন জনগণ তাদের অধীনস্থ ভৃত্য।

 

 

‘রাজনীতিবিদ বনাম সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়ম’ শিরোনামে গত ১ জুন দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সম্পাদকীয় কলামের জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তার দুর্নীতির বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রকাশিত সম্পাদকীয়র সঙ্গে আরো কিছু তথ্য যোগ করতে চাই। প্রথমেই একটি ধারণাগত বিভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। আমরা যেসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি, সেগুলো আসলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান (রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান)। সরকারের কোনো নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নেই। একটি রাজনৈতিক দল জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে মাত্র। কাজেই সরকার এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক নয়, আমানতদার মাত্র।

 

 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় চারটি বিশেষ উপাদান নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। এগুলো হচ্ছে—(ক) নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, (খ) সার্বভৌমত্ব, (গ) জনসংখ্যা এবং (ঘ) সরকার। এর মধ্যে সরকার হচ্ছে দুর্বল এবং একমাত্র পরিবর্তনশীল উপকরণ। অবশিষ্ট উপকরণগুলো নির্দিষ্ট বা স্থায়ী। কোনো রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেতে হলে নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণের ম্যান্ডেট পেতে হয়। তাই প্রতিটি সরকারেরই লক্ষ্য থাকে কীভাবে সর্বোচ্চ সততা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়।

রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে সর্বোত্তম জনকল্যাণ সাধনের মাধ্যমে জনতুষ্টি অর্জন করে পুনরায় ক্ষমতাসীন হওয়া যায়। অন্যদিকে যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন, রাজনীতিবিদদের মতো জনগণের প্রতি তাদের এমন কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করেন, তারা জনগণের সেবক। কারণ জনগণের ট্যাক্সের অর্থে তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করা হয়। জনস্বার্থে কার্য সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের কিছু ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এই ক্ষমতা একধরনের দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তা এই দায়িত্বশীলতাকে প্রশ্নাতীত ক্ষমতা বলে মনে করেন। তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যেন জনগণ তাদের অধীনস্থ ভৃত্য।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ একবার নিয়োগপ্রাপ্ত হলে নির্দিষ্ট বয়সসীমা (৫৯ বছর) পর্যন্ত তাদের চাকরি হারানোর কোনো ভয় থাকে না। এমনকি বড় ও মারাত্মক ধরনের কোনো অপরাধ করলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের চাকরি চলে যায় না। দুর্নীতির সঙ্গে দুর্ভাগ্য যুক্ত না হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে কারো চাকরি চলে যায় না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন থাকে ন্যূনতম পর্যায়ে। কেউ অপরাধ সংঘটন করলেও তার তদন্তভার অর্পিত হয় বিভাগীয় কোনো কর্মকর্তার ওপর।

বিভাগীয় কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের কোনো সহকর্মীকে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আগ্রহী থাকেন না। এছাড়া বিভাগীয় কর্মকর্তাদেরও বিকল্প উপায়ে ‘ম্যানেজ করা’ যায়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। মালিক এখানে সরাসরি উপস্থিত থাকেন না। ফলে সুশাসনের বিষয়টি প্রায়শই উপেক্ষিত থেকে যায়।

অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় সরাসরি মালিকের অধীনে। ফলে সেখানে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি করে সাধারণত পার পায় না।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৫৯ বছর পর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরিতে নিয়োগ করার বিধান পরিবর্তন করে চুক্তিভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়োগের বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। যেমন—একজন চাকরিপ্রার্থীকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলে তিন বছরের জন্য নিয়োগ করা হবে।

তিনি যদি তার নিয়োগপ্রাপ্ত পদে সঠিকভাবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তাহলে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হবে এবং পরবর্তী তিন বছরের জন্য পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হবে। এভাবে সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্ত চলতে থাকবে। কেউ যদি তার নিয়োগপ্রাপ্ত পদে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে তাকে আর পুনঃ নিয়োগ দেওয়া হবে না। এটা করা হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি-অনিয়ম করার সাহস পাবেন না।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) লেখার একটি সিস্টেম আছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অধস্তন কর্মকর্তার এসিআর লিখে থাকেন। এসিআরে খারাপ মূল্যায়ন করা হলে একজন দক্ষ ও সত্ কর্মকর্তার চাকরিজীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিরূপ হলে অধস্তন কর্মকর্তার চাকরিজীবন বিষিয়ে উঠতে পারে।

তাই এসিআর দ্বিমুখী হওয়া প্রয়োজন। অর্থাত্ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধস্তন কর্মকর্তার এসিআর লিখবেন। আর অধস্তন কর্মকর্তা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এসিআর লিখবেন। এটা করা হলে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা হবে। দুর্নীতিবাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনেক সময় এসিআরের ভয় দেখিয়ে অধস্তন কর্মকর্তাকে অন্যায় কাজে সহায়তা করতে বাধ্য করে থাকেন।

আমাদের দেশে একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, দুর্নীতি সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর তা নিয়ে হইচই করা হয়। কিন্তু দুর্নীতি যখন সংঘটিত হতে থাকে, তখন কিছুই বলা হয় না। কোনো দুর্নীতিই হঠাত্ করে সংঘটিত হয় না। এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। আর সত্ ও নীতিনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রোটেকশন দেওয়া হলে তারা দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ করে দিতে পারেন।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতির একটি বড় কারণ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় রাজনীতির চর্চা। রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী ব্যক্তিজীবনে যে রাজনৈতিক আদর্শই ধারণ করুন না কেন, চাকরিকালীন তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন এটাই নিয়ম। যে রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হোন না কেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার দায়িত্ব হবে সেই সরকারের নীতি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করা।

কিন্তু আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে একশ্রেণির কর্মকর্তাকে দলীয় রাজনীতির চর্চা করতে দেখা যায়। এরা সব সময়ই সরকারদলীয় রাজনীতি করেন। সমর্থিত রাজনৈতিক দলটি ক্ষমতার বাইরে থাকলে তারা চুপ করে থাকেন। কিন্তু যখনই তার পছন্দের দলটি ক্ষমতায় আসীন হয়, তখন তারা প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করেন।

যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পরিষদের নামে দলীয় রাজনীতির চর্চা করেন, তারা কখনোই একটি সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেন না। কারণ তাদের কর্মতত্পরতার কারণে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসীন হয় না, বরং এদের নানা অপকর্মের কারণে একটি জনপ্রিয় সরকারের দুর্নাম হয়।

অনেকেই আছেন, যারা আগের কৃত অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারদলীয় রাজনীতির চর্চা করেন। আবার অনেকেই আছেন, যারা নতুন করে দুর্নীতি করার জন্যই রাজনীতির চর্চা করেন। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে, দলীয় রাজনীতির চর্চা না করলে সাধারণত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি করা যায় না।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি চর্চার কারণে সত্ ও দক্ষ কত কর্মকর্তা যে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। দুর্নীতিবাজদের স্বার্থের প্রতিকূলে অবস্থান নিলেই তাকে সরকারবিরোধি আখ্যা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দলীয় রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইনকে সংশোধন করে যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি করেন, তাদের চাকরিচ্যুত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এসব সুবিধাভোগীর অপকর্মের দায়ভার শেষ পর্যন্ত সরকারের ওপরই বর্তায়। এদের কারণে একটি জনপ্রিয় সরকারও গণধিকৃত হতে পারে।

কেউ যদি রাজনীতির চর্চা করতে চান, তাহলে তিনি চাকরি ত্যাগ করে তা করতে পারেন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তার কোটিপতি হওয়ার সুযোগ নেই।

কিন্তু বাস্তবে শত শত কোটিপতি চাকরিজীবীর সন্ধান পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের কোনোভাবেই ক্ষমা করা উচিত হবে না।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো আরেকটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা যেতে পারে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সত্ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের বাছাই করে প্রস্তাবিত কমিশনে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

লেখক :অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!