ঢাকায় ফুটপাতের পানিতে মলের জীবাণু !

  • আপডেট সময় বুধবার, নভেম্বর ৮, ২০২৩
  • 64 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ৮ নভেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

পানির অপর নাম জীবন। সৃষ্টির অপার নেয়ামত পানি। জীবন ধারণের অপরিহার্য উপাদান পানি। কিন্তু দূষিত পানি পানে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে নানা রোগে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। রাজধানী ঢাকার পানির মান নিয়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় ওঠে এসেছে নানা তথ্য।

গবেষণায়, ঢাকা নগরীর ফুটপাতের চায়ের দোকানে ব্যবহৃত পানির ৯৪ শতাংশেই মলের জীবাণু পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ৪৪ শতাংশ পানিতে অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া এবং ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ক্ষতিকর জীবাণু ও ধাতুর সংক্রমণে মানুষ প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

গবেষণায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫০টি ওয়ার্ড থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে ১৫০টি নমুনা এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩২টি ওয়ার্ড থেকে ৯৬টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান ও খাবার বিক্রির দোকান থেকে এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় সঠিক তথ্য নিশ্চিতে সংগৃহীত নমুনা শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় আনা হয়। মাত্র দুই ঘটনার মধ্যে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরিতে সংগৃহীত পানির নমুনার পরীক্ষা শুরু হয়।

ঢাকাবাসীর পানি নিয়ে পরিচালিত এ গবেষণা শুরু হয় ২০২০ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত। ২০২১ সালের মার্চ ও এপ্রিলে নমুনা সংগ্রহ, এপ্রিল ও মে মাসে নমুনা পর্যালোচনা এবং জুন মাসে প্রতিবেদন প্রস্তুত ও চূড়ান্ত করা হয়। তবে এই গবেষণায় পাওয়া ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ বা প্রচার করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মিঠু বলেন, এই গবেষণা যখন পরিচালিত হয়েছে, তখন আমি এই প্রতিষ্ঠানে ছিলাম না।

তা ছাড়া গবেষণা যখন সম্পন্ন হয়েছে, তখন দেশের করোনা পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক পর্যায়ে। তাই এটি প্রকাশ বা প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি থেকে ঢাকার পানি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে পারলে ঢাকাবাসীর অসুস্থতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশে নগরায়ণ বেড়েছে, কিন্তু নিরাপদ পানির সংস্থান বাড়েনি। এ কারণে সুপেয় পানির লাইনে ছিদ্র করে নগরীর ভাসমান লোকেরা পানি নিয়ে থাকে। পাইপে পানির চাপ কম থাকলে এতে পয়োবর্জ্যের মিশ্রণ ঘটে। পয়োবর্জ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ই-কোলাই থাকে। এই দূষিত পানি ব্যবহারে পেটের পীড়া, হেপাটাইটিস, জন্ডিস, টাইফয়েড ইত্যাদি প্রাণঘাতী রোগের জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।

অনিরাপদ পানি পানে মানুষের শুধু স্বাস্থ্যহানি হয় না, বরং তারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ে। এসব পানি পানে যারা রোগাক্রান্ত হচ্ছে, তাদের কম অংশেরই লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে ভেতর ভেতরে পরিপাকতন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভয়াবহ অসুস্থতার মুখে পড়ে।

গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর দোকানিদের সংগ্রহ করা পানির মধ্যে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ রিকশা-ভ্যান থেকে, ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ মোটর ভ্যান থেকে, ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ পানি গভীর নলকূপ থেকে, ওয়াসা থেকে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য মাধ্যম থেকে ৫ দশমিক ১ শতাংশ পানি সংগৃহীত হয়।

ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির ৯৪ শতাংশ পানির নমুনায় ফিক্যাল কলিফর্ম (পেটের পীড়া ও ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী জীবাণু ই-কোলাই) পাওয়া গেছে। গবেষণায় ঢাকা উত্তর সিটির ৪৪ শতাংশ নমুনায় এয়ারোবিক কলিফর্ম (বায়ু থেকে পানিতে মিশ্রিত ব্যাকটেরিয়া) পাওয়া গেছে।

দক্ষিণ সিটির নমুনায় এ ধরনের জীবাণু ছিল ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ পানির নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আয়রন (লোহা) পাওয়া গেছে ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ নমুনায়। এসব নমুনায় জিংকের উপস্থিতি পাওয়া না গেলেও আর্সেনিকের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।

রোগতত্ত্ববিদ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ফিল্টার পানির নামে যাঁরা জারে ভরে পানি সরবরাহ করেন, তাঁরা মূলত প্রতারণা করেন। কারণ এসব পানি মানসম্পন্ন ফিল্টার করা হয় না। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ ২০১৪ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, পৃথিবীর ৭০০ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘ ২০০২ সালের মানবাধিকার ঘোষণায় পানিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে। এসডিজির ৭ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায়ও ছিল নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা।

প্রসঙ্গত, ঢাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রথম পানি সরবরাহ শুরু হয় ১৮৭৫ সালে। তৎকালীন ঢাকায় এই আধুনিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন নবাব খাজা আব্দুল গনী।

ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৪৮ সাল ঢাকার পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার দায়িত্ব পড়ে পাকিস্তান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের ওপর। ১৯৬৩ সালে ঢাকা ওয়াসা প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজধানীবাসীর পানি ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্ব পালন করে আসছে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!