ভেজাল খাদ্যে মহাবিপদে জনস্বাস্থ্য

  • আপডেট সময় সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
  • 85 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২৯ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় প্রতিবছরই খাদ্যপণ্যে বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত উপাদানের প্রমাণ মেলে। একইভাবে ভেজালের প্রমাণ পাওয়া যায় ওষুধেও। বিভিন্ন অভিযানে তা ধরাও পড়ে।

রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোগী আর স্বজনদের ভিড় যেন উপচে পড়ার মতো। একই রকম ভিড় শেরেবাংলা নগর এলাকার জাতীয় ইউরোলজি ও কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। দিনকে দিন ভিড় বাড়ছে নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের লিভার বিভাগে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ক্যানসার, কিডনির রোগ, লিভারের রোগ, হৃদরোগ, স্নায়ুর রোগ, ফুসফুসের রোগে মৃত্যু বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভেজাল খাদ্য বড় ভূমিকা রাখছে। সেই সঙ্গে উচ্চঝুঁকি তৈরি করছে মাতৃস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও। খাদ্যে এমন সব ভেজালের মিশ্রণ মাঝেমধ্যেই শনাক্ত হয়ে থাকে, যা মানুষের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

বলা যায়, দেশের ভেজাল খাদ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য মহাবিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝেমধ্যে অভিযানে অনেক ভেজাল মিশ্রণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ধরা পড়লেও এই প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, কেমিক্যাল মিশ্রিত বা ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে তাৎক্ষণিক প্রভাব হিসেবে পেটব্যথাসহ বমি হওয়া, মাথাঘোরা, মল পাতলা বা হজম বিঘ্নিত মল হওয়া, শরীরে ঘাম বেশি হওয়া ও দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং পালস্ রেট কমে বা বেড়ে যেতে পারে। কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ক্ষুদামান্দ্য, খাবারে অরুচি, বৃহদন্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রদাহসহ নানা রকম শাররিক জটিলতা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া মেটালবেইজড ভেজাল খাবারে কিডনি স্বল্পমাত্রা থেকে সম্পূর্ণ বিকল হতে পারে। পরিপাকতন্ত্রে ভেজাল খাবারের জন্য হজমের গণ্ডগোল, ডায়রিয়া এবং বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে এ খাবারগুলোতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিষক্রিয়া কার্যকর থাকে, যা রান্না করার পরও অটুট থাকে। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় করে এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ক্ষতিকর কার্বাইড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রং, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করা হয়। এগুলো গ্রহণের ফলে কিডনি, লিভার, অ্যাজমাসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যদিকে অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেইন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য সমিতির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, দেশে বড় কয়েকটি অসংক্রামক রোগের জন্য প্রধানত দায়ী হচ্ছে ভেজালযুক্ত খাদ্য। একদিকে অধিক মানুফার লোভে একশ্রেণির মানুষ খাদ্যে ভেজাল মেশায়। অন্যদিকে পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত খাদ্যে নানা ধরনের রাসায়নিক যুক্ত হয়ে খাদ্যকে বিষাক্ত করে তোলে। এমন অনেক রাসায়নিক আছে, যা অধিকতর তাপেও নষ্ট হয় না। এগুলো মানুষের দেহে ঢুকলে তা আর বের হয় না। জমতে জমতে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬ হাজার ৮৪৫টি নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এতে ৭৭০টি নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত বিষাক্ত উপাদান পাওয়া যায়। এসব নমুনা নেওয়া হয় চিনি, পাউরুটি, কোমলপানীয়, শুঁটকি মাছ, মিষ্টিজাতীয় খাবার, জুস, জেলি, চকলেট, গুড়, কেক, আচার, সস, দুধসহ আরও কিছু খাদ্যপণ্য থেকে।

অন্যদিকে একই প্রতিষ্ঠানের ভেজালবিরোধী কার্যক্রমের আওতায় ২০১৮ সাল থেকে গত বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৪৭০টি অভিযান পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে ৬২৫টি মামলা হয় ভেজাল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রিতে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ সময় ৬৪৭ জনের কাছ থেকে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয় এবং ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জাকারিয়া বলেন, আমরা ধীরে ধীরে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কাজে সাফল্য অর্জন করছি। মানুষ সচেতন হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরাও সচেতন হচ্ছে। তবু ভেজাল মেশানো একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা বলার সুযোগ নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ লিভারের কোনো না কোনো রোগে ভুগছেন; যা মোট জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশ। বলা যায় লিভার রোগের মহামারি চলছে দেশে। এর পেছনে অবশ্যই অন্যতম কারণ হিসেবে ভেজাল খাবারকে দায়ী করা যায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যে বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলছে, যা লিভারের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এমনকি লিভারের রোগে আক্রান্তরা ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করলে তা থেকেও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার ফলাফলে দেখানো হয়েছে, একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন পদ্ধতিতে খাবারে ভেজাল দিচ্ছেন। এর মধ্যে সাধারণত কাদামাটি, নুড়ি পাথর, বালি এবং মার্বেল চিপস মেশানো হয় খাদ্যদ্রব্যে। অন্যদিকে তরল খাদ্যে দেয়া হয় রং ও কম দামি রাসায়নিক; যা স্বাদ ভালো রাখে। তবে এসব ভেজাল সাধারণত খালি চোখে দেখা যায় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঘ্রাণেও বুঝতে পারা যায় না।

অন্যদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও ভেজালবিরোধী অভিযান চালায় মাঝেমধ্যেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় বিভিন্ন অপরাধে ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন ২০২৩ পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৭০টি ছোট-বড় অভিযানের মাধ্যমে ২৫ হাজার ৬৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার ৮০০ টাকা তাৎক্ষণিক জরিমানা আদায় করা হয়।

এ ছাড়া অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ১ হাজার ৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭ লাখ ৫ হাজার ৬০০ টাকাসহ মোট ২৬ হাজার ৭২৩টি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ কোটি ৬২ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হয়। এ ছাড়া ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে ভোক্তা অধিকার আইন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতেও কাজ চলছে বলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়।

এর আগে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট বা বিএসটিআইয়ের ৪০৬টি পণ্যের নমুনা পরীক্ষায় ৫২টিতে ভেজাল শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে লাচ্ছা সেমাই, চানাচুর, সরিষার তেল, চিপস, খাওয়ার পানি, নুডলস, হলুদ, বিস্কুট এবং ঘি, মরিচের গুঁড়া ও আয়োডিনযুক্ত লবণ রয়েছে।

গত ১ এপ্রিল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, একটি চক্র ঢাকার সাভার ও কুমিল্লায় কারখানা তৈরি করে ভেজাল ও নকল ট্যাবলেট তৈরি করত। পরে সেগুলো নিয়ে বরিশালে গুদামজাত করত। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় কুরিয়ারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো। চক্রটি ১০ বছর ধরে ভেজাল ওষুধ তৈরি করে আসছিল। সম্প্রতি এ চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের নামে এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা করা হয়েছে।

অতিরিক্ত কমিশনার জানান, এ পর্যন্ত ৮০টি ইউনানি ওষুধ কোম্পানির ভেজাল ওষুধ তৈরির বিষয়ে তথ্য তারা ঔষধ প্রশাসনকে দিয়েছেন।
অভিযানে ধরা পড়া আরেক ঘটনায় দেখা যায়, দেশের বাজারে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা দামের কোরিয়ান একটি ভ্যাকসিন আসলে কেরানীগঞ্জে তৈরি করত একটি চক্র। আবার গর্ভবতী মায়েদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ওষুধ মাত্র ১০ টাকার টিটেনাস ওষুধ মিলিয়ে নকল সিল বসিয়ে বাজারে বিক্রি করত একটি চক্র। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশি-বিদেশি নকল অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তৈরি করত তারা।

এ ছাড়া সম্প্রতি রাজধানীর কোতোয়ালি ও কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে নকল ভ্যাকসিন ও ওষুধ তৈরির অভিযোগে চক্রের চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ডিবির অভিযানে প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধসহ একটি বড় চক্রকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তারা মিটফোর্ড থেকে ওষুধের কাঁচামাল সংগ্রহ করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ইনজেকশন তৈরি করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছিল।

এ বিষয়ে ডিবি প্রধান বলেন, এসব নকল ওষুধের কার্যকারিতা না থাকায় সাধারণ মানুষ কোনো উপকার পেত না। বরং নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতো। তারা এমনভাবে এসব ওষুধ হুবহু প্যাকেজ করত, সাধারণ মানুষের বোঝার উপায় নেই, কোনটা আসল আর কোনটা নকল।

সন্তান জন্মের সময় প্রসূতি মায়েদের ব্যথা উপশমের জন্য ব্যবহার করা হয় ‘জি-পেথিডিন’ ইনজেকশন। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ ইনজেকশনই দীর্ঘদিন ধরে নকল করে বাজারজাত করে আসছে একটি চক্র। ৮ টাকার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে তৈরি পেথিডিন নামের ভুয়া ওষুধটি তৈরি করে ৬০০ টাকায় বিক্রি করত তারা।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!