রাজনীতির দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান খেলা

  • আপডেট সময় রবিবার, নভেম্বর ১৯, ২০২৩
  • 69 পাঠক

জায়েদুল করিম চৌধুরী পলাশ
১৯ নভেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ।

বাংলাদেশ। বর্তমানে বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্রোতের উল্টোদিকে বহমান একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাম। সাম্য, ন্যায় বিচার সামাজিক মর্যাদাসহ মৌলিক অধিকারগুলো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র হলেও এখন প্রশ্ন ওঠছে, সেগুলোর বাস্তবতা এবং মৌলিক ভিত্তি নিয়ে। এমন সব প্রশ্নের ‘অসম্পূর্ণ’ উত্তর নিয়েই ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল।

তফসিল ঘোষণার পূর্বেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডলান্ড লু’র ‘খুব সম্ভবত’ সর্বশেষ একটি অফিসিয়াল চিঠি বা বার্তা ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে। যার মর্মার্থ- নিঃশর্ত একটি সংলাপের আয়োজন করা। তবে লক্ষণীয় বার্তা ছিল চিঠির শেষ অংশে, তা হলো পুনরায় ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া।

একই চিঠি তিনি তার দেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তবে ‘দৃশ্যমান’ ভাবে এই চিঠির কোনো ভাল ফলাফল লক্ষ্য করা যায়নি। বলা যায় দুটি দল ছাড়া সরকারি দল কার্যত চিঠিটি প্রত্যাখ্যানই করেছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ তার চিরচেনা পথে হাঁটলো। বড়, ছোট, ডান, বাম, মধ্য এমন কি ইসলামিক দলসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ঘোষিত তফসিলকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে ঘোষিত তফসিলের প্রতিবাদে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি। অন্যদিকে এমন অনিশ্চয়তার মুখে আবারও থমকে গেল ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য !

বর্তমান সরকার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম। গত ১৫ বছরে এ সরকার রাষ্ট্রের যতগুলো ‘ওরগান’ অকার্যকর করেছে তাও নজিরবিহীন। উল্লেখযোগ্যভাবেই বলা যায় দুর্নীতি, অর্থ লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

খুচরা বাজারে ডলারের মূল্যও রেকর্ড ভেঙেছে। বাংলাদেশ জন্মের পর এই প্রথম ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র খুলতে হিমশিম খাচ্ছে। যা সহজেই ফুটে উঠেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, তার ৩৬ বছরের কর্মজীবনে দেশের অর্থনীতির এ হাল দেখেন নি।

দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে গত এক মাসে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩৫ শতাংশ। বিশ্ব যখন শ্রমিক অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ঠিক তখনই বাংলাদেশে শ্রমিকরা তাদের পারিশ্রমিক বাড়ানোর দাবিতে রাজপথে। প্রায় সপ্তাহখানেকের এই আন্দোলনে একজন নারীসহ পাঁচজন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। যদিও এমন শ্রমিক আন্দোলন ঈদ,উৎসব, পূজা-পার্বণসহ বিভিন্ন সময়ে চলমান থাকে। এ মুহূর্তে বিভিন্ন চাপের মুখে শ্রমিকরা কাজে ফিরলেও যে কোনো মুহূর্তে তা যে ফুঁসে ওঠবে না-সেটার নিশ্চয়তা খুবই কম। এমনই এক পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন পলিসি ঘোষণা করেছে।

যাতে বলা হয়েছে- বিশ্বের শ্রমিক অধিকার আদায়ের পক্ষের শক্তি, সংগঠন, কর্মীদের যেসব দেশ বা ব্যক্তি হুমকি, দমন-পীড়ন, নির্যাতন করে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে সেই সব দেশ বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়ে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।

বিশেষ করে অর্থবহ হলো, সদ্য ঘোষিত পদক্ষেপের একটি অংশে শুধুমাত্র বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের একজন নারী শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তার নাম উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এই ধরনের মানুষ আমাদের চাই। তিনি বেঁচে আছেন কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষে কথা বলেছে তাই।

এর কার্যকারিতায় বাংলাদেশের পোশাক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরির আশঙ্কা করছেন অনেকে। ইতোমধ্যে এই ঘোষণায় উক্ত খাতের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উক্ত ঘোষণার অংশবিশেষ নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের জন্য একটি ‘ভয়াবহ ইঙ্গিত’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে।

এদিকে গত ১৫ নভেম্বর (তফসিল ঘোষণার দিন) সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থায় ঘাটতি, সুশাসন, নাগরিকদের অধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমসহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউপিআর)। এ সভায় এক সঙ্গে ১১০টি সদস্য রাষ্ট্র ৩০১টি সুপারিশ তুলে ধরেছে বাংলাদেশের জন্য। যা বাংলাদেশের জন্য মোটেও সুখকর নয়। অন্তত আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে।

এছাড়া ‘১৪/১৮ সালের মতো বর্তমান সরকার পুনরায় নির্বাচনের ‘জয়’ লাভের জন্য প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয়করণ জনমনে আস্থার সংকট তৈরি করেছে প্রবলভাবে। জনমনের এ অবিশ্বাস আগামী নির্বাচনকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে এবার অন্তত মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

পক্ষান্তরে বলা যায়, দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে বটে, কিন্তু সেটি কতটা পরিকল্পিত এবং দুর্নীতিমুক্ত ছিল বা হয়েছে তেমন প্রশ্ন তো ওঠছেই। মনে করা হচ্ছে, উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ এবং লুটপাটের মধ্য দিয়ে বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাসকে আরও দীর্ঘায়িত করছে প্রতিনিয়তই।

২। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি:

চীন এবং ভারতের রশি টানাটানিতে জনগণ ত্যাক্ত-বিরক্ত। বর্তমান শাসকশ্রেণি ক্ষমতার জন্য দুই দেশকেই কাজে লাগাতে চায় ‘অসম’ দেয়া-নেয়ার মধ্যে দিয়ে। ইতোমধ্যে চীন টোপ দিয়েছে তলানিতে যাওয়া বাংলাদেশের রিজার্ভে অর্থ যোগান দিতে। কর্নেল ফারুক খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিনিধি দল সম্প্রতি চীন সফর করেন।

পক্ষান্তরে ভারতও আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পাশে থাকার ‘প্রচ্ছন্ন’ ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছে বলে আওয়ামী লীগ প্রচার করছে।

এখন প্রশ্ন করাই যায় :

ক) চীন এবং ভারত তাদের চির বৈরীতা ভুলে গেলো?

খ) নাকি হাসিনা সরকার দুই দেশের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে পড়ে নতুন কোনো বেড়াজালে ‘আটকে যাচ্ছে?

গ) যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলের বড় মিত্র ভারত বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব পলিসি পরিবর্তন করবে?

৩) কারণ, পক্ষান্তরে পশ্চিমা বিশ্ব জোটবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে উদ্ধার করতে। যার ফলশ্রুতিতে আগামী সংসদ নির্বাচনকে তারা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করাতে মরিয়া। যার ফলশ্রুতিতে গত এক বছর থেকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশকে যার ধারাবাহিকতায় নভেম্বরের শেষের দিকে এই চাপের ‘ধরণ ও তীব্রতা’ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভারত পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আসন্ন চাপকে কতটা রুখতে পারবে ? এই ত্রি-মাত্রিক আন্তর্জাতিক খেলা এবং বিরোধী দলসমূহ তফসিল প্রত্যাখ্যান করে যে আন্দোলনের ছক কষছে, আওয়ামী লীগ সরকার তা কতটা সামলাতে পারবে। তা কিছু দৃশ্যমান, অনেক কিছু এখনো অদৃশ্যমানও বটে।

 

লেখক- শিল্প উদ্যোক্তা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!