মাসে আড়াই হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে এলপিজি সিন্ডিকেট !

  • আপডেট সময় শুক্রবার, জানুয়ারি ২৬, ২০২৪
  • 112 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ২৬ জানুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

প্রতি মাসের প্রথম দিকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। কিন্তু কখনোই সরকারনির্ধারিত সেই দামে এলপিজি বিক্রি হয় না। সিলিন্ডারপ্রতি ভোক্তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় অতিরিক্ত ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এই হিসাবে মাসে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ভোক্তার কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে এলপিজি সিন্ডিকেট।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি পর্যবেক্ষণ বলছে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এলপিজির চাহিদা ৯০ লাখের বেশি। সেই হিসেবে প্রতিটি সিলিন্ডার থেকে যদি ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা বেশি নেওয়া হয় তাহলে গড়ে মাসে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে গ্রাহকের পকেট থেকে।

বাজার ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন আকারের সিলিন্ডার থাকলেও মূলত চাহিদা রয়েছে ১২ কেজির সিলিন্ডার। ১২ কেজি সিলিন্ডারের জানুয়ারি মাসের জন্য দাম নির্ধারণ করে দেয়া আছে ১৪৩৩ টাকা। কিন্তু দেখা গেছে, ভোক্তার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ১৬০০ থেকে ‌১৮০০ টাকা পর্যন্ত।

একই অবস্থা ঢাকার বাইরেও। ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামে দেখা গেছে, কোথাও সরকারনির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে না। ভোক্তা অধিকার মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও তেমন সুফল মিলছে না।

পরস্পরকে দোষারোপ, ভোক্তা হচ্ছে চিড়েচ্যাপ্টা

এই পরিস্থিতির জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে সংশ্লিষ্টরা। খুচরা বিক্রেতারা দোষারোপ করছেন ডিলারদের, ডিলাররা দোষারোপ করছেন বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আর বোতলজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুষছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি)। কিন্তু এই ফাঁকে লুটপাটের শিকার হচ্ছেন ভোক্তরা।

ঢাকার একজন খুচরা বিক্রেতা জানান, সরকারনির্ধারিত দাম ১৪৩৩ টাকা। কিন্তু ডিলাররাই বিক্রি করছেন ১৪৫০ থেকে ১৪৭০ টাকায়। এর সঙ্গে যোগ হবে পরিবহন খরচ, দোকান ভাড়া ও স্টাফ খরচ। সবমিলিয়ে টিকে থাকাই মুশকিল। মামলার ভয়ে নাম প্রকাশ করতে চান না ওই খুচরা বিক্রেতা।

ওই খুচরা ব্যবসায়ী আরও বলেন, ৫০টা মাল আনতে গাড়িভাড়া দিতে হয় ২ হাজার টাকা। তাহলে প্রতিপিসে কত ভাড়া পড়ল? প্রায় ৪০ টাকা। দোকান ভাড়া স্টাফ খরচ আরও ৫০ টাকা যোগ করেন। রেগুলার গ্যাস বিক্রি করি ৩০টি। তাহলে খরচ ১৬০০ টাকায় গিয়ে পড়ে।

তবে ডিলাররা দোষ দিচ্ছেন সিলিন্ডারে গ্যাসজাতকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কারখানার মালিকদের। তারা বলছেন, ‘কোম্পানি যদি ঠিক করে দিত একটা ডিস্ট্রিবিউশন হাউস ৮০ থেকে ৯০ টাকা প্রফিট রাখতে পারবে। তাহলে আমাদের জন্য ভালো হতো। আমাদের গোডাউনেই আসছে সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে।’

এলপিজি সিলিন্ডার পরিবেশক সমিতির সভাপতি সেলিম খান বলেন, ‘ রিটেইলার পর্যায়ে কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ টাকা। অথচ ৬০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। তাহলে আসলে কত করে আমরা বিক্রি করব? আমরাও আসলে অসহায়।’

বর্তমানে এলপি গ্যাসসিলিন্ডারে ভরার ব্যবসা করছে মোট ২৮টি কোম্পানি। এসব কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের দাবি, বিইআরসির দাম নির্ধারণ ফর্মুলা বাস্তবসম্মত নয়। পরিবহনের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খরচ সমন্বয় করা হয় না এতে। তারা বলছেন, বাজার অস্থিতিশীল কোনোভাবেই হতো না যদি বিইআরসি ও অপারেটরদের সমন্বয়ে ডিস্ট্রিবিউটরদের রিয়াল মার্জিনটা তুলে ধরা হতো। প্রাইসিং ফর্মুলা অ্যাকিউরেট করতে হবে। না হলে ডিস্ট্রিবিউটর ও রিটেইলাররা সারভাইভ করতে গিয়ে দাম বাড়াবেই।

তবে বিইআরসি সচিব খলিলুর রহমান খান বলছেন, ‘ প্রয়োজনীয় প্রমাণ দিয়ে সহযোগিতা করে না অপারেটরগুলো। তারা যদি কোনো কাগজ না দেন তাহলে কীভাবে বুঝব তাদের কী খরচ হচ্ছে? আমরা প্রতিবার বলি আমরা গণশুনানি করব আপনারা ডকুমেন্ট দেন। আপনাদের মুখের কথায় তো দাম বাড়াব না।’

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সদস্য কাজী আবদুল হান্নান বলেন, বিইআরসি বলবে একজন ডিস্ট্রিবিউটরের এরিয়া কতটুকু। এই এরিয়ার ভেতরে কত সিলিন্ডারের বাজার থাকবে। সেই বাজারে কতজন ডিলার থাকবে, কতজন রিটেইলার থাকবে। এগুলো তারা নির্ধারণ করেনি। এগুলো ঠিক করলে এ অবস্থা হতো না।

সংকটকে পুঁজি করে দাম নিয়ে নৈরাজ্য

বাসাবাড়িতে গ্যাসের লাইন থাকলেও গ্যাস পাওয়া যায় না নিয়মিত। ঢাকাসহ সারা দেশে এমন দেখা গেছে, তিতাসের গ্যাস লাইন আছে কিন্তু গ্যাস না পাওয়ায় নিরুপায় হয়ে সিলিন্ডার ব্যবহার করেন ভোক্তা। তাদের অভিযোগ, এই সুযোগটাই নিচ্ছে সিন্ডিকেট। তারা হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান কারখানা প্রতিনিধি, ডিলার, খুচরা ব্যবসায়ী ও ভোক্তা প্রতিনিধিদের নিয়ে একবার বৈঠক করেছিলেন। সেই বৈঠকে তিনি সংশ্লিষ্টদের বলেন, ‘ভোক্তার স্বার্থ আমাদের দেখতে হচ্ছে। আমরা চাই সরকারনির্ধারিত দামে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘৯০ লাখ সিলিন্ডারে মিলগেটে যদি ১০০ টাকা করে বেশি নেয়া হয়, তাহলে প্রতি মাসে অতিরিক্ত লাভ কত হচ্ছে? ভোক্তাদের পকেট থেকে সিলিন্ডারপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। তাহলে প্রতি মাসে ভোক্তার পকেট থেকে কত টাকা যাচ্ছে? বিইআরসি যদি দাম বাড়িয়ে দেয় তাহলে যে ভোক্তারা ওই দামে পাবে, তা বিশ্বাস হয় না। চিনির দাম বাড়িয়েও যেমন কোনো লাভ হয়নি।’

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!