কাগজ ও ছাপার মান এত খারাপ হবে কেন

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৪
  • 32 পাঠক

————————————————————————————
পাঠ্যবই 

————————————————————————————

তারিক মনজুর । ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

গত কয়েক বছরের মতো এবারও পাঠ্যবইয়ের কাগজ ও ছাপার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কাগজের পুরুত্ব ও উজ্জ্বলতায় মানা হয়নি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্দেশনা।

একটি সংবাদমাধ্যম বলছে, বইগুলোর উজ্জ্বলতা মেপে দেখার চেষ্টা করা হয়। পৃষ্ঠার উজ্জ্বলতা যেখানে হওয়ার কথা ৮০ শতাংশ, সেখানে ঢাকার ভেতরের বইয়ে পাওয়া গেছে ৬০-৬৫ শতাংশ, আর ঢাকার বাইরের বইয়ে ৫৫ শতাংশের নিচে। একইভাবে বইয়ের কাগজের জিএসএম (গ্রাম/স্কয়ার-মিটার) নির্ধারিত ৮০ গ্রামের জায়গায় বেশির ভাগ বইয়েই ৬০-৭০ গ্রাম দেখা যায়।

নিম্নমানের কাগজ ও কালিতে ছাপা বই শিশুদের চোখের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন চক্ষুবিশেষজ্ঞেরা। এনসিটিবির চেয়ারম্যান বরাবরই বলে আসছেন, মানসম্মত বই দিতে ব্যর্থ হলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার এবং তাদের কালোতালিকাভুক্ত করার সুযোগ আছে। এর আগে এমনটি করাও হয়েছে। কিন্তু এবারের মতো খারাপ ছাপার বই শিক্ষার্থীদের হাতে আসেনি।

মাধ্যমিক পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে রচিত প্রতিটি বইয়ে এবারই প্রথম চাররঙা ছবি যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া এবারই প্রথম এসব বইয়ে লেখা ও অনুশীলন করার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। এগুলো নিশ্চিত করার জন্য কাগজের উজ্জ্বলতা ও পুরুত্ব ভালো হওয়ার দরকার ছিল।

আগামী এক বছর এসব বই পড়ার উপযোগী থাকবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অভিভাবকদের অভিযোগ, অনেক শিক্ষার্থীর নতুন বইয়ের সেলাই খুলে যাচ্ছে। আবার বইয়ের ছবির মান ও রং এতটাই অস্পষ্ট ও খারাপ যে অনেক ক্ষেত্রে এগুলো ঠিকমতো বুঝতেও কষ্ট হয়। কোনো কোনো জায়গায় ছাপা থেকে কালি উঠে যাচ্ছে বা লেপটে যাচ্ছে। এসব নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে।

এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৩ কোটি ৮২ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৩৫ কোটি কপি বই বিতরণ করা হচ্ছে। বই ছাপার জন্য যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়, তখনই অনুমান করা গিয়েছিল বইয়ের মান এবার খারাপ হতে পারে।

কারণ, এনসিটিবি ফর্মাপ্রতি যে হিসাবে বইয়ের দাম নির্ধারণ করেছিল, মুদ্রণকারীরা তার চেয়ে কম দরে ছাপার কাজ নেন। যেমন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ফর্মাপ্রতি বইয়ের প্রাক্কলিত দর গড়ে তিন টাকা ধরা হয়। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণিতে মুদ্রণকারীরা ফর্মাপ্রতি সর্বনিম্ন দর দেন গড়ে ১ টাকা ৯৩ পয়সা, আর সপ্তম শ্রেণিতে ১ টাকা ৭৯ পয়সা।

এত অল্প টাকায় ছাপানোর ফল কী হতে পারে, তার নমুনা এখন প্রকাশ পাচ্ছে ! এনসিটিবি বলছে, দরপত্রে মুদ্রণকারীরা কম দর দিলে তাদের কিছু করার থাকে না।

আগের বছরও সরকারের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অন্তত ২৫ শতাংশ কম খরচে পাঠ্যবই ছাপার কাজ নেন ছাপাখানার মালিকেরা। গতবার ভালো মানের পাল্পের (কাগজ তৈরির মণ্ড) সংকটের কারণে উজ্জ্বলতার ক্ষেত্রে ‘অলিখিতভাবে’ ছাড় দিয়েছিল এনসিটিবি। অথচ সেই ছাড়ের চেয়ে খারাপ কাগজে বই ছাপা হয়।

ছাপার কাজে ব্যবহার হওয়া কাগজের মিল ও ছাপাখানাগুলোর অধিকাংশের বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ছাপা হওয়া বইয়ের বেশির ভাগই প্রক্রিয়াজাত করা কাগজে ছাপানো হচ্ছে। দেশে বর্তমানে শতাধিক কাগজকল থাকলেও এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির বিএসটিআইয়ের মানসনদ আছে।

কিছু মুদ্রণকারী নিউজপ্রিন্ট-জাতীয় কাগজ দিয়ে বই ছাপায়। এ বছর কাগজের মান কমিয়ে দেয়া হয়। কাগজের সংকটের কথা মাথায় রেখে উজ্জ্বলতায়ও ছাড় দেয়া হয়। তবু বইয়ের মান রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

২০২২ সালে মাধ্যমিক স্তরে নিম্নমানের কাগজ ক্রয় ও অনুমোদনহীন কাগজে বই ছাপানোর অভিযোগে ১১টি ছাপাখানার বিপুলসংখ্যক বই ও কাগজ বিনষ্ট করা হয়।

ছাপাখানার মালিকদের অভিযোগ, বই ছাপার কাজ করে এনসিটিবির কাছ থেকে বিল পেতে দেরি হয়। এ কারণে তাঁরা সময়মতো ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারেন না। আর নতুন করে ছাপানোর সময়ে যথেষ্ট অর্থ তাঁদের কাছে থাকে না। ডলার–সংকটের কারণে আমদানি করা কাগজের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও লোকসান গুনতে হয়। যেমন ন্যূনতম মান নির্ধারণ করে যখন এনসিটিবি দরপত্র আহ্বান করে, তখনকার কাগজের দাম আর বই ছাপানোর সময়ে ওই কাগজের দাম এক থাকে না। ফলে ছাপাখানার মালিকদের পক্ষে কোনোভাবেই শর্ত অনুসারে কাগজ কিনে বই ছাপানো সম্ভব নয়।

দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে ৮০ জিএসএম কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা মণ্ড থাকার কথা। আর বইয়ের কভারে ২৩০ জিএসএমের আর্ট কার্ড (মোটা কাগজ) ব্যবহার করতে হয়, যার প্রতি টনের দাম ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো।

তবে ব্যবসায়ীরা যখন দরপত্রে অংশ নেন, তখন ৮০ জিএসএম কাগজের টনপ্রতি মূল্য ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা কম ছিল। এ ছাড়া ব্যবহৃত কাগজ কতটা মজবুত, তার নির্দেশনাকারী ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ ন্যূনতম ১২ শতাংশ থাকার কথা।

ছাপার কাজে ব্যবহার হওয়া কাগজের মিল ও ছাপাখানাগুলোর অধিকাংশের বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সনদ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ছাপা হওয়া বইয়ের বেশির ভাগই প্রক্রিয়াজাত করা কাগজে ছাপানো হচ্ছে। দেশে বর্তমানে শতাধিক কাগজকল থাকলেও এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটির বিএসটিআইয়ের মানসনদ আছে।

সাধারণত চার ধাপে পাঠ্যবই ছাপানো তদারক করা হয়। প্রথম ধাপে কাগজের মান পরীক্ষা করা হয়, দ্বিতীয় ধাপে বইয়ের ছাপা দেখা হয়, তৃতীয় ধাপে বাইন্ডিং যাচাই করা হয় এবং চতুর্থ ধাপে সব ঠিকঠাক আছে কি না, সেটা দেখা হয়। এরপর বইয়ের ছাড়পত্র দেয়া হয়। ছাড়পত্র দেয়ার পরও ছয় মাসের ‘ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড’ থাকে, অর্থাৎ ত্রুটি থাকলে সেই বই পুনরায় ছাপানোর আদেশ দেওয়া যায়। বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য তদারকি প্রতিষ্ঠানও কাজ করে। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক কম। তাদের দেয়া রিপোর্টও সব সময় নির্ভরযোগ্য হয় না।

অভিজ্ঞজন মনে করেন, বই ছাপানোর কাজ পেতে প্রাক্কলিত দামের চেয়ে কম টাকায় কাজ নেয়ায় মান খারাপ হচ্ছে। এ সমস্যা দূর করার জন্য প্রাক্কলিত দরের ১০ শতাংশের নিচে দর গ্রহণ না করার বিধান রাখা উচিত। আর বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য বিএসটিআই বা সায়েন্সল্যাবকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।

এ ছাড়া এনসিটিবির নির্ধারিত মান পূরণে ব্যর্থ ছাপাখানাগুলোকে কেবল কালোতালিকাভুক্ত করলে চলবে না, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!