ওএসডি চিকিৎসকরাও বেতন, ভাতা সবই পান ?

  • আপডেট সময় শনিবার, মার্চ ৯, ২০২৪
  • 55 পাঠক

দিশারী ডেস্ক। ০৯ মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই ৭ হাজার ৪৫৯ জন চিকিৎসককে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রেখেছে, যা সরকারি চিকিৎসক সংখ্যার ২১ শতাংশ।

বিশেষ ভারপ্রাপ্ত মানে হলো, এই চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়া থেকে দূরে রয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসক–স্বল্পতার এটি অন্যতম কারণ। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক–স্বল্পতার কারণে রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে সেবা পান না। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ভালো চিকিৎসা না পেয়ে রোগীদের নিয়ে ঢাকায় আসার প্রবণতা রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চারটি কারণে সরকারি কর্মক্ষেত্রের চিকিৎসকেরা ওএসডি হন। প্রথমত, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা ছুটি নেন চিকিৎসকেরা। দ্বিতীয়ত, লিয়েন বা ছুটি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে (সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার বাইরে) কাজ করা। তৃতীয়ত, অনুমোদিত পদের চেয়ে পদোন্নতি পাওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি হলে কাউকে কাউকে ওএসডি করে রাখতে হয়। চতুর্থত, অপরাধ করলে শাস্তি হিসেবে ওএসডি করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে ওএসডি হওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা ৫০ জনের কম। অন্যদিকে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার জন্য ওএসডি হওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ওএসডির সুবিধা ভোগ করছেন। অনেকে যোগ্য হয়েও সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে কার্যকর নীতিমালা দরকার।

চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী মনে করেন, চিকিৎসকদের বড় সংখ্যায় ওএসডি হিসেবে রাখার প্রবণতার অবসান হওয়া উচিত। এত অধিকসংখ্যক চিকিৎসককে ছুটিতে রাখার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। তিনি বলেন, অনুমোদিত পদ অনুযায়ী জনবল থাকার পরও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের স্বল্পতার একটি বড় কারণ অধিকসংখ্যক ওএসডি।

চিকিৎসকদের সমস্যাটি পুরোনো। জেলা-উপজেলায় চিকিৎসকদের নিয়োগ দেয়ার পর দেখা যায়, কয়েক মাস থেকেই তাঁরা ওএসডি হয়ে চলে আসেন। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, সভা হয়েছে। তবে সমস্যা সমাধানের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

এরই মধ্যে ৫ মার্চ রাজধানীর বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন সেন্টারে আয়োজিত স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞদের সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, জাতীয় সংসদে গেলে সংসদ সদস্যরা সরকারি হাসপাতাল সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসক বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হয়ে আছেন। এটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক–স্বল্পতার অন্যতম কারণ।

সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, জাতীয় সংসদে গেলে সংসদ সদস্যরা আমাকে বলেন তাঁর এলাকায় চিকিৎসক থাকে না। যেখানেই যাই, সেখানেই হাসপাতালে ডাক্তার থাকে না শুনতে পাই। এগুলো তো ভালো কথা না। উপজেলা হাসপাতালে যদি ডাক্তার থাকতে না চায়, তাহলে গ্রামের মানুষ কোথা থেকে ভালো চিকিৎসা পাবে ?

বিপুলসংখ্যক চিকিৎসককে ওএসডি করে রাখার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, আগামী রমজান মাসে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনায় বসব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা হাসপাতাল, জেলা বা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসকদের জন্য অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৩৫ হাজার ৫০৩। হিসেব অনুযায়ী, ৭ হাজার ৪৫৯ জন চিকিৎসক ওএসডি হয়ে আছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই নিয়মিত বেতন-ভাতা পান।

নিয়ম অনুযায়ী, অনুমোদিত পদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা যায়। তবে অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে ১০ শতাংশ কর্মকর্তাকে ওএসডি করার কোনো নজির শোনা যায়নি। সরকারের নিয়ম মানলে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৫৫০ জন চিকিৎসককে ওএসডি করার সুযোগ ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দ্বিগুণের বেশি চিকিৎসককে ওএসডি করেছে।

এক বছর আগে, ২০২৩ সালের ২০ মার্চ মাঠপর্যায়ে চিকিৎসক–সংকট নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়েছিল। সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ওই সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক ওএসডি থাকার কারণে মাঠপর্যায়ে আশঙ্কাজনকভাবে চিকিৎসক সংকট তৈরি হয়েছে।

কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, ওই সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) বলেছিলেন, শিক্ষার জন্য ওএসডি হওয়া চিকিৎসকদের অনেকে কোর্স শেষ হওয়ার পরও যথাসময়ে কাজে যোগদান করেন না। তিনি আরও বলেন, কোনো কোনো চিকিৎসক কোর্সে উত্তীর্ণ হতে অসমর্থ হলে তারা পর্যায়ক্রমে শিক্ষাছুটি, অর্জিত ছুটি, এমনকি অসাধারণ ছুটি গ্রহণ করেও ডিউটি পোস্টের (কর্মস্থল) বাইরে অবস্থান করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহায়তায় কোনো কোনো চিকিৎসক দফায় দফায় ছুটি নিতে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা একজন বলেন, এক চিকিৎসক প্রথমে স্ত্রীরোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য সব মিলিয়ে তিন বছর ছুটি নিয়েছিলেন। ডিগ্রি শেষে কাজে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে স্ত্রীরোগের ‘সাব-স্পেশালিটি’ বন্ধ্যত্বের ওপর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য আবার দুই বছরের ছুটি নেন। এ রকম উদাহরণ অনেক আছে।

২০২১ সালে একজন কর্মকর্তাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ‘ লিভ রিজার্ভ ’ হিসেবে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। অর্থাৎ পদোন্নতি হলেও পদ না থাকায় তাঁকে ওএসডি করে রাখা হয়। তাঁকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংযুক্তিতে রাখা হয়েছিল। ওই চিকিৎসক চট্টগ্রাম চলে যান। তিনি চট্টগ্রামে থাকেন ও পেশা চর্চা করেন। তিনি এখনো ওএসডি হিসেবে বেতন-ভাতা তুলছেন বলে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

অবশ্য ওএসডি হওয়া ওই চিকিৎসক অভিযোগ করেন, তাঁকে কাজের সুযোগই দেয়া হচ্ছে না। কোথাও পদায়ন করা হচ্ছে না। তাঁর প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে।

নানা করণে অন্যান্য পেশার মতো সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা নিয়মিত কর্মক্ষেত্রে হাজির থাকেন না—এমন অভিযোগ নতুন নয়। তবে সরকারের কাছ থেকে নেয়া বেতনের টাকা ফেরত দিয়েছেন সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছয়জন চিকিৎসক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নজরদারিতে ধরা পড়েছিল যে ওই ছয়জন চিকিৎসক গত বছর ছুটি না নিয়েই বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে অনুপস্থিত ছিলেন। অধিদপ্তর তাঁদের অনুপস্থিতির দিনগুলোর সমান বেতন ফেরত দিতে বলে। এতে কেউ ২৬ হাজার, কেউ ৪০ হাজার টাকা ফেরত দিয়েছেন।

শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ওই ছয়জন আগের চেয়ে সেবাদানের ক্ষেত্রে নিয়মিত হয়েছেন, এটা বলা যায়।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, স্নাতকোত্তর চিকিৎসাশিক্ষার জন্য চিকিৎসকদের ওএসডির দরকার আছে। তবে সেই উচ্চতর শিক্ষা হাসপাতালের সেবায় ছাড় দেওয়ার বিনিময়ে যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, কোন কোন বিষয়ে কতজন চিকিৎসকের উচ্চতর ডিগ্রি দরকার, তা নির্ধারণ করা নেই, পরিকল্পনাও নেই। সেটাও দরকার।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!