যাদের তাওবা কবুল হয় না

  • আপডেট সময় সোমবার, জুলাই ২৯, ২০২৪
  • 61 পাঠক

শায়খ মুহাম্মদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ। ২৯ জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ।

তাওবা শব্দটি এক মহান শব্দ। এর অর্থ খুবই গভীর। তাওবা এমন নয় যে মুখে শব্দটি বললাম অতঃপর পাপে লিপ্ত থাকলাম। আল্লাহ কী বলছেন দেখুন—‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন (তাওবা) করো।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৩)

কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্য অবশ্যই কিছু শর্ত থাকে। আলেম-ওলামারা কোরআন ও হাদিস থেকে তাওবার জন্য কিছু শর্ত উল্লেখ করেছেন, তা হলো :

১. দ্রুত পাপ থেকে বিরত হওয়া।

২. আগে যা ঘটে গেছে সে জন্য অনুতপ্ত হওয়া।

৩. পুনরায় পাপকাজে ফিরে না আসার জন্য দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।

৪. মানুষের পাওনা পরিশোধ করে দিতে হবে। প্রাপকদের হক ফিরিয়ে দেবে, যা অন্যায়ভাবে নেওয়া হয়েছিল অথবা তাদের কাছে থেকে মাফ চেয়ে নেবে।

বিশুদ্ধভাবে তাওবার জন্য কিছু আলেম যেসব শর্ত উল্লেখ করেছেন, নিচে সেগুলো উদাহরণসহ আলোচনা করা হচ্ছে।

১. শুধু আল্লাহর জন্য পাপ ত্যাগ করা। অন্য কোনো কারণে নয়, যেমন— অক্ষমতার কারণে পাপ থেকে দূরে থাকা, এসব কর্ম করতে ভালো না লাগা অথবা লোকজন মন্দ বলবে—এই ভয়ে পাপ ত্যাগ করা। এ জন্য কোনো ব্যক্তিকে তাওবাকারী বলা হবে না, যে ব্যক্তি পাপ ত্যাগ করেছে তার মানহানি ঘটায় বা এর জন্য হয়তো সে চাকরিচ্যুত বা পদবি হারাতে পারে।

ওই ব্যক্তিকেও তাওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি পাপ ত্যাগ করল তার শক্তি ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। যেমন—কেউ জেনা করা ত্যাগ করল যেন দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বাঁচতে পারে অথবা তার শরীর ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল না করে।

তেমনি তাকে তাওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে; কোনো বাড়িতে ঢোকার পথ না পেয়ে বা সিন্দুক খুলতে অসমর্থ কিংবা পাহারাদার ও পুলিশের ভয়ে।

ওই ব্যক্তিকে তাওবাকারী বলা যাবে না, যে দুর্নীতি দমন বিভাগের লোকজনদের জোর তৎপরতায় ধরা পড়ার ভয়ে ঘুষ খাওয়া বন্ধ রেখেছে। ওই ব্যক্তিকেও তাওবাকারী বলা যাবে না, যে ব্যক্তি মদ পান, মাদকদ্রব্য বা হেরোইন সেবন ইত্যাদি ছেড়ে দিয়েছে দারিদ্র্যের কারণে।

তেমনি তাকেও তাওবাকারী বলা যাবে না, যে সমর্থহীন হওয়ার কারণে গুনাহ করা ছেড়ে দিল। যেমন—মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়েছে তার কথায় জড়তা সৃষ্টি হওয়ার কারণে কিংবা জেনা করছে না যেহেতু সে সহবাস করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কিংবা চুরি করা ছেড়ে দিয়েছে আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ার কারণে।

বরং এসবে অবশ্যই অনুতপ্ত হতে হবে, সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত হতে হবে এবং অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অনুতপ্ত হওয়াই হলো তাওবা।’ (ইবনে মাজাহ, সহিহ আল-জামে, হাদিস : ৬৮০২)

২. পাপের কদর্যতা ও ভয়াবহতা অনুভব করা। অর্থাৎ সঠিক তাওবার সঙ্গে কখনো আনন্দ ও মজা পাওয়া যাবে না অতীত পাপের কথা স্মরণ হলে অথবা কখনো ভবিষ্যতে সেসব কাজে ফিরে যাবে, এ কামনা মনে স্থান পাবে না।

ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) তাঁর লিখা ‘রোগ ও চিকিৎসা’ ও ‘আল-ফাওয়াইদ’ নামের গ্রন্থে গুনাহের অনেক ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হওয়া, অন্তরে একাকিত্ব অনুভব করা, কাজকর্ম কঠিন হয়ে যাওয়া, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, আল্লাহর আনুগত্য থেকে বঞ্চিত হওয়া, বরকত কমে যাওয়া, কাজে সমন্বয় না হওয়া, গুনাহর কাজে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া, আল্লাহর ব্যাপারে পাপীর অনাসক্তি সৃষ্টি হয় এবং লোকজন তাকে অশ্রদ্ধা করে, জীবজন্তু তাকে অভিশাপ দেয়, সে সর্বদা অপমানিত হতে থাকে, অন্তরে মোহর পড়ে যায়, লানতের মাঝে পড়ে এবং দোয়া কবুল হয় না, জলে ও স্থলে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়, আত্মমর্যাদাবোধ কমে যায়, লজ্জা চলে যায়, নিয়ামত দূর হয়ে যায়, আজাব নেমে আসে, পাপীর অন্তরে সর্বদা ভয় নেমে আসে এবং সে শয়তানের দোসরে পরিণত হয়, তার জীবন সমাপ্ত হয় মন্দের ওপর এবং পরকালীন আজাবে নিপতিত হয়। পাপের এই ক্ষতি ও বিপর্যয় যদি বান্দা জানতে পারে তাহলে সে পাপ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকবে।’

৩. যার জন্য তাওবার প্রয়োজন সে যেন তাড়াতাড়ি তাওবা করে। কারণ তাওবা করতে দেরি করা পাপ।

৪. আল্লাহর হক যা ছুটে গেছে তা যথাসম্ভব আদায় করা। যেমন—জাকাত দেয়া, যা সে আগে দেয়নি। কেননা এতে আবার দরিদ্র লোকজনের অধিকারও আছে।

৫. পাপের স্থান ত্যাগ করা, যদি সেখানে অবস্থান করলে আবার সে পাপে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

৬. যারা পাপকাজে সহযোগিতা করে তাদের পরিত্যাগ করা। মহান আল্লাহ বলেন : ‘ আন্তরিক বন্ধুরাই সেদিন একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হবে, মুত্তাকিরা ছাড়া।’ (সুরা : আল-জুখরুফ, আয়াত : ৬৭)

৭. নিজের কাছে রক্ষিত হারাম জিনিসকে নষ্ট করে ফেলা। যেমন—মাদকদ্রব্য, বাদ্যযন্ত্র (যেমন—একতারা, হারমোনিয়াম) অথবা ছবি, ব্লু ফিল্ম, অশ্লীল নভেল বা নাটক। এগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তাওবাকারীকে সঠিক পথে দৃঢ়ভাবে থাকার জন্য অবশ্যই পাপের উপকরণ থেকে মুক্ত হতে হবে।

৮. ভালো সঙ্গী-সাথী গ্রহণ করতে হবে, যারা তাকে দ্বিনের ব্যাপারে সহায়তা করবে। আর চেষ্টা করতে হবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ইললি আলোচনায় বসার জন্য। নিজেকে সব সময় এমন কাজে মশগুল রাখতে হবে যাতে কল্যাণ আছে, যেন শয়তান তাকে আগের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সুযোগ না পায়।

৯. নিজ শরীরের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যাকে সে হারাম দিয়ে লালন-পালন করেছে। একে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লাগাতে হবে এবং হালাল রুজি খেতে হবে, যেন শরীরে আবার পবিত্র রক্ত-মাংস সৃষ্টি হয়।

১০. তাওবা দম আটকে যাওয়া বা জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে এবং পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগে হতে হবে। নবী কারিম (সা.) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তাওবা করবে গড়গড়া ওঠার আগে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন।’ (সহিহ আল জামে, হাদিস : ৬১৩২)

মহান আল্লাহ আমাদের তাওবা কবুল করুন।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!