আমীর খসরু
২৫ অক্টোবর ২০২৪
বর্তমানে বাংলাদেশে যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে তা শুধু রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিষয়টির কারণ আরও গভীরে। আর এই দফার আসল সংকটের পর্যায়টি শুরু হয়েছে, ছাত্র- জনতার বিপ্লবী আন্দোলনের পরে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ বা পালিয়ে যাওয়ার দিন অর্থাৎ ৫ই আগস্ট। সংকটের প্রথম প্রশ্নটি হচ্ছে ছাত্র- জনতার আন্দোলন, শত শত মানুষের জীবন দান ও অসংখ্য আহত হওয়ার বিষয়টি কী বিপ্লব না গণঅভ্যুত্থান সেখানেই। স্বরূপ অনুসন্ধানেই আসলে বোঝা যাবে সংকটটি কেন ?
বিপ্লব একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া। আর বিপ্লব হচ্ছে, সমাজের বিদ্যমান কাঠামো উল্টে দিয়ে সাধারণ জনতার অর্থাৎ সর্বজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শুধু ভোটের গণতন্ত্র নয়-সমাজে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়নীতির সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থাপন।
বিপ্লব কোনো সাংবিধানিক বিষয় নয়-বিষয়টি রাজনৈতিক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মৌল চেতনাটি ছিল সেটি। বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ৫ই আগস্ট মাঝপথে ঠেকিয়ে দেয়ার উদ্যোগটি আসে বিদ্যমান কাঠামোর পক্ষের শক্তির দিক থেকেই। আগেই বলা হয়েছে বিপ্লব সংবিধান মেনে হয় না
কিন্তু ৫ আগস্ট বর্তমানের একজন উপদেষ্টা, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সেনাপ্রধান সংবিধান মেনে সবকিছু করা হবে বলে ঘোষণা দেন। আর এর মধ্যদিয়েই চলমান বিপ্লবের সম্ভাবনাকে বানিয়ে ফেলা হয় গণঅভ্যুত্থানে।
১৯৭১-এর মুক্তিযুুদ্ধের চেতনাকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে মুক্তিযুদ্ধ আসলে একটি বিপ্লবের বিষয়। যদি সংবিধান মেনে, বিদ্যমান কাঠামো মেনে তখন চলা হতো তাহলে বাংলাদেশের জন্মই হতো না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ ও আগের পুরো রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংবিধানের পথে না গিয়ে একই সঙ্গে জনগণ বিপ্লবের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পথ বেছে নেয়। যদি সংবিধান মানা হতো তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো।
১৯৭১-এর পরের সরকারদলীয় একটি সরকার গঠন করে যে গোঁজামিলের সূচনা করেছিল তারই একটি ধারায় ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লবী চেতনার আন্দোলন। কিন্তু বিদ্যমান কাঠামোগত সংকট মীমাংসা না করে সংবিধান মানার কথা বলা হলো।
মনে রাখতে হবে, গোঁজামিলমুক্ত একটি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অসীম সম্ভাবনাকে গলা টিপে ধরা হলো। সংবিধান প্রশ্নে সংকটটি হচ্ছে-মূল সংবিধান অর্থাৎ ১৯৭২-এর সংবিধানটি কাটাছেঁড়া করে পরবর্তীকালে এক ‘অদ্ভুত’ সংবিধানে পরিণত করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন আসছে, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি তাহলে কী এই সংবিধানের পক্ষেই কথা বলছে?
আরেকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক, বিদ্যমান দ্বিদলীয় বিভাজনের রাজনীতির মধ্যে আসলে কোনো গুণগত পার্থক্য আছে কি? পার্থক্যটা কি ক্ষমতার পালা বদলের? দ্বিদলীয় সরকার ব্যবস্থা আমাদের মতো দেশে আসলে কি ফ্যাসিস্ট? পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে আমরা না হয় তোমরা। এই একই পথে হাঁটাহাঁটি চলছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এরও আগের সময়ের যে মৌল চেতনা ও দাবিগুলো পাশ কাটিয়ে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠিত হলো তা আসলে বারংবার আসল সংকটকে পাশ কাটানোর শামিল। বিখ্যাত সমাজ বিশ্লেষক এবং গণবুদ্ধিজীবী প্রফেসর হামজা আলাভী এই পরিস্থিতিকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ওভার ডেভলাপ্ট’ স্টেইট বলে।
ওভার ডেভলাপ্ট স্টেইট হচ্ছে বিদ্যমান সংকটকে জিইয়ে রেখে উপরিতলার নেতৃত্ব বদল। এতে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৪৭ সালের তৎকালীন পাকিস্তান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশ ওই বৃত্তের বাইরে বের হতে পারেনি। এতে বিদেশি শক্তিগুলোর প্রভাব, আধিপত্য ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির খপ্পরে পড়ে গেল দেশগুলো। পাকিস্তানে এ কারণেই ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল ১৯৪৭ এবং পরবর্তীকালের গোঁজামিল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। কিন্তু রাজা যায়, রাজা আসে-অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে। ২০২৪ এর মূল চেতনা হচ্ছে-অমীমাংসিত বিষয়ের স্থায়ী সমাধান। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ বা পলায়ন এবং পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যায়, ওই অমীমাংসিত বিষয়গুলোর যে স্থায়ী সমাধানের অসীম সম্ভাবনা ছিল তা বিপথে পরিচালিত হলো।
কয়েকটি প্রশ্ন এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন-৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের বিষয়টি কীভাবে এবং কারা আয়োজন করলো ? সেনাপ্রধান বলেছেন, তিনি দেশত্যাগের বিষয়টি আগেভাগে অবহিত ছিলেন না। এই বয়ানটি কতোটা বিশ্বাসযোগ্য ?
তাহলে প্রশ্ন আসবেই শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের দুই দিনের মাথায় এসে বিএনপি চাপ দিতে থাকে নির্বাচনের। ছাত্ররা একটি গ্রহণযোগ্য একটি কাঠামো বদল সম্ভব এমন একটি নেতৃত্ব চাইছিলেন তাদের সামনে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে খুঁজে বের করা হলো। কিন্তু মনে রাখতে হবে ড. ইউনূস বিদ্যমান কাঠামোর পক্ষেরই একজন মানুষ। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা কেউই ছাত্র-জনতার মূল চেতনাকে ধারণ করার শক্তি নয়, দ্বন্দ্বটি সেখানেই।
১৯৭১-এর পরবর্তী একটি জাতীয় সরকার গঠিত হলে এবং অমীমাংসিত বিষয় সমাধান হলে আজকের এই সংকট সৃষ্টি হতো না। কিন্তু সবাই এখনো এই একই বৃত্তে অর্থাৎ শুধু ভোটের গণতন্ত্র নিয়েই ব্যস্ত। অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি তারা চাইছেন না। দিনে দিনে গোঁজামিলের পথ আরও সংকটের সৃষ্টি করছে।
এখন আসল প্রশ্নটি হচ্ছে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পদত্যাগ করবেন কিনা, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ ছাত্রদের নতুন ৫ দফার মধ্যে কাঠামোগত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ৫ দফা আসলে এক দফা-অর্থাৎ কাঠামোগত পরিবর্তন ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
যে মূল বিষয়টি নিয়ে কেউই মুখ খুলছেন না তাহলো ভারতের নীতি কৌশল। ভারতের বাংলাদেশ নীতি না শেখ হাসিনা নীতি সে প্রশ্নটি সবার মাথার মধ্যে আসলে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভারতের হাসিনা নীতি বাংলাদেশের মানুষ কতোটা পছন্দ করছে- সেটি এখন বিশাল প্রশ্ন। ভূরাজনৈতিক বিষয়টি অর্থাৎ চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে আমলে নিতে হবে। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের নিষিদ্ধ করার দাবি আসলে মূল সংকটের একটি উপসর্গ।
আসল সংকট হচ্ছে বাংলাদেশ কী আন্তর্জাতিক শক্তির প্রভাবমুক্ত ? স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বহিঃশক্তির প্রভাবহীন রাজনীতি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এক কথায় স্বাধীন নীতি কৌশল গ্রহণের বিষয়কেন্দ্রিক।
এসব প্রশ্নের মীমাংসা না করে শুধু নির্বাচনের দিনক্ষণ গুনলে সংকট আরও বাড়বে। এবং এটাই বড় সংকটের মূল কারণ। বার বার মানুষ রাস্তায় নামবে- এটা ভাবা ঠিক নয়। মানুষ রাজনীতিবিমুখ হলে দেশটি বিপন্ন হবে।
কাজেই অমীমাংসিত বিষয়াবলীর স্থায়ী নিষ্পত্তি ও সুরাহা সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ। যতক্ষণ না এই গোঁজামিলের পথ ছেড়ে সমস্যার স্থায়ী নিষ্পত্তি হয় ততদিন এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
সৌজন্যে : অন্য দৈনিক।
Leave a Reply