৮ জানুয়ারি একজন নির্মল সেনের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, জানুয়ারি ৭, ২০২৫
  • 18 পাঠক

রকিবুল ইসলাম ।৭ জানুয়ারি, ২০২৫

সময়টা ১৯৭৪। নির্মল সেনের কলাম বন্ধ করা হয়েছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। জরুরি অবস্থা জারির পরপর নির্মল সেনের লেখা বন্ধের নির্দেশ আসে। সত্তর ও আশির দশকের কীর্তিমান সাংবাদিক নির্মল সেন। তিনি ছিলেন রাজনীতিকও। তুখোড় এ সাংবাদিক ও কলামিস্ট শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার মতো স্পর্ধা আর সাহসিকতা দেখিয়েছেন।

সময়টা ১৯৭৪। নির্মল সেনের কলাম বন্ধ করা হয়েছিল তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। জরুরি অবস্থা জারির পরপর নির্মল সেনের লেখা বন্ধের নির্দেশ আসে। দৈনিক বাংলার তখনকার সম্পাদক তখন নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী তাকে ডেকে বললেন, প্রধানমন্ত্রী আপনার লেখা বন্ধ করেছেন। নির্দেশ দিয়েছেন ‘অনিকেত’ ছদ্মনামে নির্মল সেনের উপসম্পাদকীয় আর দৈনিক বাংলায় ছাপা হবে না।

————————————————————————

স্মৃতিচারণ

———————————————————————-

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সেই সময়ের সভাপতি নির্মল সেন গণভবনে ছুটে গেলেন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে। বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘ আপনি আমার লেখা বন্ধ করলেন কেন। আপনার কথা আমি মানব না। আমি আজকেই এই গণভবন থেকে ফোনে দৈনিক বাংলায় আমার লেখা দেব।’ প্রধানমন্ত্রী খানিকটা গম্ভীর হলেন, ইংরেজিতে বললেন, ‘ নির্মল সেন, আপনাকে আমি জেলে পুরব না, এতে আপনি জনপ্রিয় হবেন। আপনার জন্য একটি সিসার গুলিই যথেষ্ট।’ উত্তরে নির্মল সেন বললেন, ‘ প্রধানমন্ত্রী, একই কথা আপনার জন্যও প্রযোজ্য। আপনার জন্যও একটি সিসার গুলিই যথেষ্ট।’

একজন প্রধানমন্ত্রী ও একজন সাংবাদিকের মধ্যে কথোপকথন ! তাই বলে নির্মল সেনকে সেই সময় হয়রানির শিকার হতে হয়নি, কিংবা তাকে গুমও হতে হয়নি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।দাবি আদায় করেই গণভবন ছাড়েন নির্মল সেন। তিনি সেদিন গণভবন থেকেই ফোনে দৈনিক বাংলার জন্য লেখা পাঠিয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাকে নিবৃত্ত করতে পারেননি।

অবশ্য বাকশাল গঠনের পর তার কলাম আবার বন্ধ করা হলো। সরকারি নিয়ন্ত্রণে চারটি দৈনিক রেখে সব বন্ধ করে দেয়া হলো। এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে তুখোড় সাংবাদিক নেতা নির্মল সেন যান শেখ মুজিবের কাছে। সেদিনও তর্ক হয় দুজনের মধ্যে। শেখ মুজিব বলছিলেন, ‘ ইউ আর গোয়িং ঠু ফার, নির্মল সেন !’ নির্মল সেন কি চুপ হয়ে গেলেন ? মোটেও না। তিনি শেখ মুজিবের চোখে চোখ রেখে বলেছিলেন, ‘ইউ আর আ লায়ার।’

nirmal

এই হলেন নির্মল সেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে কিংবদন্তিতুল্য এই সাংবাদিক ছিলেন বাম রাজনীতির পুরোধাও। একজন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজচিন্তক। ১৯৩০ সালের ৩ আগস্ট গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার দিঘীরপাড় গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্ম তার। বাবা সুরেন্দ্রনাথ সেন গুপ্ত ও মাতা লাবণ্য প্রভা সেন গুপ্ত।

১৯৪৬ সালে নির্মল সেনের পিতা মাতা তার চার ভাই ও তিন বোনকে নিয়ে কলকাতা চলে যান। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসার টানে তিনি দেশেই থেকে গেলেন। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে নির্মল সেন বড় হয়েছেন ঝালকাঠি জেলায় তার পিসির বাড়িতে। কলসকাঠি বিএম একাডেমি থেকে ১৯৪৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তী সময়ে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ ও এমএ সম্পন্ন করেন নির্মল সেন।

অর্থনীতির জ্ঞান তিনি সাংবাদিকতা, রাজনীতি আর সমাজসেবায় কাজে লাগিয়েছেন। তার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ও সাংবাদিক এখন খুঁজে পাওয়া ভার। চিরকুমার নির্মল সেন সাদামাটা জীবনে সাদা পাজামার সঙ্গে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরতেন। পোশাকে, চলনে, কথাবার্তায় ছিলেন অসম্ভব ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন। নির্লোভ ও সাহসীও ছিলেন বটে। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন নির্মল। তিনি সত্যিই ছিলেন নির্মল বা বিশুদ্ধ এক মানুষ।

এখন কী দেখছি আমরা ? সংবাদমাধ্যমে এসেছে—সাংবাদিক মুন্নি সাহার ব্যাংক হিসাবে ১৩৪ কোটি টাকা, নাইমুল ইসলাম খান ও তার পরিবারের ১৬৩টি ব্যাংক হিসাবে ৩৮৬ কোটি টাকার লেনদেন। এ গেল মাত্র দুটি নজির। এমন শত সাংবাদিক আজ অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন, যা তাদের আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। নির্মল সেন প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখিয়েছেন, চোখে চোখ রেখেছেন।

কিন্তু এখনকার অধিকাংশ সাংবাদিকের মধ্যে সেই সৎ সাহসিকতার জায়গায় আছে মোহ, অর্থলিপ্সা। এর পেছনে অবশ্য তারাই শুধু দায়ী নয়। দায়ী রাষ্ট্রযন্ত্রের রক্তচক্ষুও। মিডিয়াকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সব সরকারের আমলেই। পক্ষে থাকলে মিলে পুরস্কার, আর বিপক্ষে গেলে তিরস্কার আর হয়রানি। এর প্রভাব পড়ে তৃণমূলেও। মাঠ পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তাও সাংবাদিককে শাসিয়ে দেন।

অথচ নির্মল সেনের মতো বরেণ্য সাংবাদিক, যিনি ছিলেন সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠনের নেতাও, তিনি কারো কাছ থেকে অন্যায্যভাবে কোনো সুবিধা নেননি, কীভাবে নিতে হয় সেটিও জানতেন না। সাংবাদিকতার জগতে তিনি একটি উদাহরণ তৈরি করে গেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বাতিঘর।

নির্মল সেনের ভাবনাগুলো আজও বড্ড প্রাসঙ্গিক। নির্মল সেন তিয়াত্তরের মার্চে ‘ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই ’ কলাম লিখেছিলেন দৈনিক বাংলায়। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হলো কেবলই। হত্যা, গুম, খুন তখন ছিল প্রতিদিনের খবর। চিত্রটা কি এখন পাল্টেছে ? এখনো আমাদের বলতে হয় ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই ’। অথচ এই কথাটি নির্মল সেন বলেছেন আরো ৫২ বছর আগে।

নির্মল সেন তার কলামে কাঁপিয়ে দিতেন শাসকগোষ্ঠীর ভিত। তার সমালোচনার কাঁটায় বিদ্ধ হতো শেখ মুজিবের সরকার। প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন, নির্মল সেনের লেখার শেষে হুল থাকে। শেখ মুজিব জানতেন, সবাইকে বাগে আনতে পারলেও নির্মল সেনকে আনা যাবে না। নির্মল সেন বঙ্গবন্ধুর মুখের ওপরে বলে দিয়েছিলেন, তিনি বাকশালে যোগ দেবেন না। তাকে ভালো করেই চিনতেন বলে শেখ মুজিব সবাইকে বলে দিলেন নির্মল সেনকে যেন তারা না ঘাঁটায়।

নির্মল সেনের রাজনীতি ও সাংবাদিকতা এক সূত্রে গাথা। রাজনীতি আর সাংবাদিকতা দুটোই তিনি করেছেন নিখাদ দেশপ্রেম থেকে। বাবা-মামা-ভাই-বোন সবাই কলকাতায় চলে গেলেও তিনি একাকী জীবনের কষ্ট বরণ করে নেন শুধু দেশপ্রেমের কারণেই। সারাটা জীবন দেশের জন্য কাজ করেছেন রাজনীতির স্লোগানে কিংবা কলমের ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে। রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় স্কুলে থাকাকালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে। শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতি। তিনি মানুষের ভাতের, ভোটের অধিকারের জন্য রাজনীতি করেছেন। কখনো কখনো সরকারের বিরাগভাজন হয়েছেন। ফলে ছাত্রজীবনে জেলও খেটেছেন।

তবে রাজনীতিকের চেয়ে সাংবাদিক হিসেবেই তিনি বেশি খ্যাতিমান। বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার শুরু হয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা দিয়ে, ১৯৫৯ সালে। এরপর কাজ করেছেন দৈনিক আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলায়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও ১৯৭৩-৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।

ছিলেন সাংবাদিকতার শিক্ষকও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ১০ বছর অতিথি শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন। সমসাময়িক ইস্যু, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তার লেখা ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’, ‘মানুষ সমাজ রাষ্ট্র’, ‘বার্লিন থেকে মস্কো’, ‘মা জন্মভূমি’, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’, ‘আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ’ ও ‘আমার জবানবন্দি’ গ্রন্থগুলো সাড়া জাগায়।

এত বড় সাংবাদিক ও রাজনীতিক শেষ বয়সে অর্থাভাবে চিকিৎসাও করাতে পারেননি! ২০০৩ সালে ব্রেন স্ট্রোকের পর রাজনীতিক ও পেশাজীবীদের আর্থিক সহায়তায় তাকে সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও ৫৯ দিন চিকিৎসার পর অর্থাভাবে চিকিৎসা শেষ না করেই তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। সেই থেকে নিজ গ্রামেই ছিলেন। ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নির্মল সেন ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন।

৮ জানুয়ারি এই কীর্তিমান সাংবাদিকের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী।

লেখক :  বণিক বার্তার জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!