দিশারী ডেস্ক। ১২ জানুয়ারি, ২০২৫
অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচারের রোগীকে অজ্ঞান করতে অ্যানেসথেসিয়া অ্যান্ড ভেন্টিলেটর মেশিনে ব্যবহৃত হয় আইসোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার। জীবনরক্ষাকারী এ যন্ত্র কেনাকাটায়ও অভিনব দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে।
চীন থেকে আনা ভ্যাপোরাইজারে ১০০ টাকার নকল স্টিকারে নাম পরিবর্তন করে যন্ত্রের গায়ে জার্মানির বিখ্যাত একটি কোম্পানির নাম লিখে বেশি দর দেখিয়ে হাতানো হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এমন অভিনব দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রের একমাত্র মেরামতকারী সংস্থা ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) কেনাকাটায়।
——————————————————————————-
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিমিউ অ্যান্ড টিসির একটি সিন্ডিকেটের সরাসরি যোগসাজশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো এসব দুর্নীতি ঘটিয়েছে, যেখানে বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ পর্যন্ত বেশি দাম রাখা হয়েছে। কেনা হয়েছে চার শতাধিক ভ্যাপোরাইজার। একেকটি কেনা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। এতে হাতানো হয়েছে ৪ কোটি টাকার বেশি।
——————————————————————————-
অনিয়মের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্তাদের বক্তব্য, সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী হওয়ার কথা। স্টিকার পরিবর্তন করে আরেক দেশের বলে চালিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে এমন বক্তব্যের সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে জেনেছেন। অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, অস্ত্রোপচারের আগে রোগীকে অজ্ঞান করতে দীর্ঘদিন ধরে হ্যালোথেন ব্যবহার হয়ে আসছিল। কিন্তু এটি ব্যবহারে রোগীর অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময় কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও জটিলতা দেখা দেয়ায় বিশ্বব্যাপী এটাকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ও গত বছরের জানুয়ারিতে অ্যানেসথেসিয়ায় ভেজাল হ্যালোথেন ব্যবহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) তিন শিশুর মৃত্যু হয়। তখনো বিষয়টি অনেকটা গোপন ছিল। কিন্তু সুন্নতে খাতনা করাতে গিয়ে রাজধানীর নামকরা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে একের পর এক শিশু মারা গেলে হ্যালোথেনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও জটিলতার বিষয়টি দেশব্যাপী সামনে আসে এবং সরকার এর ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর থেকেই দেশে হ্যালোথেন সরবরাহ বন্ধ রেখেছে একমাত্র অনুমোদিত কোম্পানি এসিআই। এসব মৃত্যুর পেছনে ভারতীয় চোরাইপথ থেকে আসা ভেজাল হ্যালোথেন থাকতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
গত বছরের ৩১ মার্চ দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল, বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ও অ্যানেসথেসিয়া ভেন্টিলেটর মেশিনে হ্যালোথেন ভ্যাপোরাইজারের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন অথবা সেভোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার ব্যবহারের নির্দেশনা দেয় সরকার। এরপর দেশের প্রায় সব হাসপাতালে এসব ভ্যাপোরাইজার স্থাপনে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরে এটি কেনাকাটাও স্থাপনের দায়িত্ব পায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন চিকিৎসাযন্ত্র মেরামতকারী সংস্থা নিমিউ অ্যান্ড টিসি।
—————————————————————————
ইতোমধ্যে, রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুড়িগ্রাম জেলা সদর হাসপাতাল, লালমনিরহাট জেলা সদর হাসপাতাল, কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অসংখ্য হাসপাতালে ভ্যাপোরাইজার স্থাপন করেছে নিমিউ অ্যান্ড টিসি। অন্তত চারটি টেন্ডারে নাতাশা হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, সেন্স ও বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের তিনটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো কেনা ও স্থাপন করা হয়।
—————————————————————————
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিটি আইসোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার যন্ত্রই চীনের। আমদানির পর হাসপাতালে সরবরাহের আগে চীনের স্টিকার সরিয়ে নকল বিখ্যাত জার্মানির হায়ার ব্রান্ডের নামের স্টিকার লাগানো হয়। নিমিউ অ্যান্ড টিসির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চলে এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি।
গত বছরের শুরুতে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে ১৯টি আইসোফ্লুরেন ভ্যাপোরাইজার সরবরাহ করে নিমিউ অ্যান্ড টিসি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সেন্স লিমিটেড এগুলো সরবরাহের কাজ পায়। এগুলোর প্রত্যেকটির গায়ে ঝুলছে জার্মানির বিখ্যাত ব্রান্ড হায়ারের নকল স্টিকার। তবে হাসপাতালটির চিকিৎসক ও বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ানরা ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন।
রমেক হাসপাতালের একজন বায়োমেডিকেল জানান, নিমিউ অ্যান্ড টিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান। টেন্ডারের মাধ্যমে তারা এগুলো সরবরাহ করছে। কিন্তু সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা ও সরবরাহকারী ঠিকাদার কোম্পানিগুলো মিলে অভিনব দুর্নীতি করছে। তারা এক দেশের যন্ত্র আরেক দেশের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। চীনের প্রতিটি যন্ত্রের দাম ৫৮ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু জার্মানির স্টিকার লাগিয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ধরা হয়ছে প্রতিটি ভ্যাপোরাইজারের দাম। ফলে ১৯টি ভ্যাপুরাইজারেই কোটি টাকা হাতিয়েছে সিন্ডিকেট।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে রংপুর মেডিকেলের আইসিটি ‘ নাহিদ (ইন্সট্রুমেন্ট কেয়ারটেকার) যিনি স্বাস্থ্যের বড় দুর্নীতিবাজ আওয়ামী মাফিয়া লেক্সিকনের মালিক মিঠুর আত্মীয়।’
এমন জালিয়াতির বিষয়ে জানতে চাইলে রমেক হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রধান ডা. তাইফুর রহমান বলেন, এতে আমাদের করার কিছু থাকে না। নিমিউ যেহেতু সরকারি প্রতিষ্ঠান, তারা এক কোম্পানি বলে আরেক কোম্পানির যন্ত্র দিলে সেই দায় তাদের। তারা যেভাবে দেয় সেভাবেই আমরা গ্রহণ করি।
একই প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালেও। গত বছর হাসপাতালটিতে দুটি ভ্যাপোরাইজার যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। দুটিই চীনা কোম্পানির হলেও জার্মানির হায়ার কোম্পানির নকল স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
হাসপাতালটির একজন বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ান বলেন, মাত্র ১০০ টাকার নকল স্টিকারে চীনের যন্ত্র জার্মানির হয়ে যাচ্ছে। এগুলো লেজার দিয়ে লেখা হয়। জার্মানির হায়ারের একটি ভ্যাপোরাইজারের দাম ৪ লাখ ৮০ হাজার থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশে মূল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডলফিন মেড। কোনো জবাবদিহি না থাকায় নিমিউ অ্যান্ড টিসি এমন অহরহ প্রতারণা করেই যাচ্ছে এবং তাদের ধরার কেউ নেই। কারণ নিমিউ সরাসরি মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
—————————————————————————
এদিকে রাজধানীর একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত বছর পাঁচটি ভ্যাপোরাইজার সরবরাহ করে বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স নামের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। সেখানেও একই জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। বিষয়টি ধরতে পেরে হাসপাতালটির বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ানরা বিল আটকে দেন। কয়েক দফায় ইনস্টলেশন বিল স্বাক্ষর চেয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেয় নিমিউ অ্যান্ড টিসি। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় পরে বাধ্য হয়ে জার্মানির স্টিকার পরিবর্তন করে পুনরায় চীনের স্টিকার লাগানো হয়।
—————————————————————————
নিমিউ অ্যান্ড টিসির কর্মকর্তাদের ভয়ে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না ওই হাসপাতালের বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ানরা। তারা বলেন, এক দেশের যন্ত্র অন্য দেশের বলে চালিয়ে দিয়ে ৬০ হাজার টাকার যন্ত্র আড়াই লাখ টাকার বিল করছে। নিমিউ অ্যান্ড টিসির এমন জাল-জালিয়াতি এটা একেবারে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এক বছর ধরে ভ্যাপোরাইজার স্থাপন হলেও এখনো মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ (সার্ভে) করেনি নিমিউ অ্যান্ড টিসি। স্টিকার পরিবর্তন করে অন্য দেশের নামে যন্ত্র লাগানোর বিষয়ে জানে না বলেও জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
সবচেয়ে বেশি সরবরাহকারী ঠিকাদারের একটি সেন্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী এম এ সাইয়েদ বলেন, অনেকে অনেক কথা বলবে। বিভিন্ন কোম্পানি সরবরাহ করেছে। এরপর থেকে সশরীরে দেখা করার কথা বলে ফোন কেটে দেন। তবে বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে জবাব দেননি তিনি।
অন্যদিকে বেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্সের প্রধান নির্বাহী জন সোহেল বলেন, আমরা না অন্য আরেকটি কোম্পানি চীনের যন্ত্র জার্মানি বলে চালিয়ে দিয়েছে। আমি এই একটা কাজই পেয়েছি। যারা চীনের যন্ত্র জার্মানির বলে চালিয়েছে তারা ভুল করেছে।
তবে অনিয়মের ৮০ ভাগই মিথ্যা বলে দাবি করেন নিমিউ অ্যান্ড টিসির টেকনিক্যাল ম্যানেজার (রিপেয়ার) ড. মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, টেন্ডার করলে কোম্পানি নমুনা দেখায়। সে অনুযায়ী মাল সরবরাহ করে। আমরা অর্ডার দিয়েছি, কতগুলো লাগানো হয়েছে আমার জানা নেই। তবে যেসব হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে এখনো সার্ভে হয়নি, ফলে প্রকৃত অবস্থা জানি না। কিন্তু অর্ডার ছাড়া কোনো ঠিকাদার লাগিয়ে থাকলে আমাদের করার কিছু নেই। তারপরও কোনো রকম দুর্নীতি হয়ে থাকলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে।
সৌজন্যে : ভিন্ন দৈনিক।
Leave a Reply