আসমানি ফয়সালা যে কোনো মুহূর্তে আমাদেরকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে

  • আপডেট সময় শনিবার, মে ৮, ২০২১
  • 707 পাঠক

——————–
মারুফ কামাল খান সোহেল
———————

মরহুম সাংবাদিক-রাজনীতিক তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে কিছুকালের জন্য আমি সাংবাদিকতায় ঊর্ধতন সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম। সেটা দৈনিক দেশ-এ কাজ করবার সময়। সাবেক ছাত্রনেতা তাহের ঠাকুর পাকিস্তান আমলে দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ রিপোর্টার ছিলেন।

সে জামানায় শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের নেতৃত্বের ভাবমূর্তি তৈরিতে তিনি বিরাট ভূমিকা রাখেন। স্বনামে ‘জনতা সাগরে জেগেছে ঊর্মি’ শিরোনামে ইত্তেফাকে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর সিরিজ রিপোর্ট করতেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য এবং শেখ মুজিবুর রহমানের কেবিনেটে তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন তাহের ঠাকুর। মুজিবহত্যার পর মোশতাক সরকারে অন্যান্য মন্ত্রীর সঙ্গে তাহের ঠাকুরের মন্ত্রীত্বও বহাল থাকে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া খোন্দকার মোশতাকের ভাষণসমূহও ছিল তাহের ঠাকুরেরই লেখা।

সুন্দর অভিজাত চেহারা ছিল তার। কণ্ঠস্বর ছিল চমৎকার। বেশভূষায় সব সময় নিপাট পারিপাট্য বজায় রাখতেন। কথাবার্তায় ছিলেন দারুণ চৌকশ। লিখতেনও দারুণ। অধুনালুপ্ত দৈনিক দেশ-এর শেষ পর্বে তিনি উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।

তাহের ঠাকুর ১৯৭৫ সালের মুজিবহত্যা ও জেলহত্যায় জড়িত ছিলেন বলে ব্যাপক প্রচার ছিল। আওয়ামী ঘরানার লোকজন তাকে অন্যতম চক্রান্তকারী বলে জানতেন। তবে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এবং সম্পাদকীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমি তার প্রবল মুজিবভক্তি ও ভারতপ্রীতির প্রমান পেতাম। পরে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে মুজিবহত্যা ও জেলহত্যা উভয় মামলায় আসামি করে এবং গ্রেফতার করে জেলে রাখে। তবে বিচারে তাহের ঠাকুর বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন।

খুব তুখোড় আড্ডাবাজ লোক ছিলেন তাহের ঠাকুর। অফিসে এসেই আমাকে ডাকতেন। বাসা থেকে পিতলের ঝকঝকে পাত্র ভরে আনতেন সাজানো পান। সেটা খুলতেই সুগন্ধী জর্দার সুরভীতে ঘর মৌ মৌ করতো। তার চেয়ারের পাশে একটা পিকদানিও রাখা ছিল। আমারও তখন পান খাবার নেশা ছিল জব্বর। ধুমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিংবা আয়েশ করে পান চিবুতে চিবুতে জমে উঠত আড্ডা। তাতে শামিল হতেন সহকর্মীদের অনেকেই।

‘নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন হয়। তখন আওয়ামী লীগের প্রতি তাহের ঠাকুরের অনুকূল মনোভাব আরো পরিস্কার হয়ে যায়। আমরা ছিলাম তখন বিএনপির পাগলপারা সমর্থক।

একদিন একটু ক্ষুব্ধ হয়েই তাকে বললাম, এতো বেশি আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ করেন, কিন্তু ওরা তো আপনাকে খুনি ও চক্রান্তকারী বলে। ওরা ক্ষমতায় এলে তো আপনাকে লটকে দেবে।

আমার ডাক নাম ধরে ডাকতেন তিনি। খানিকটা ম্লান হাসি হেসে বললেন, সোহেল ভাই, একটা কথা বলি শোনেন। মনে রাখবেন, জগতের অনেক কিছুর ফয়সালাই কিন্তু মানুষের হাতে নেই। সেগুলোর ফয়সালা হয় আসমানে। আমরা দুনিয়ার মানুষ এক রকম পরিকল্পনা করি কিন্তু আসমানি ফয়সালায় তা সম্পূর্ণ উল্টে যায়।

তারপর তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে একটা মেসাল দিয়ে বললেন, ইন্ডিয়ায় মিসেস গান্ধীর ব্যাপারটা দেখুন। তার দুটি ছেলে। বড়টি রাজিব – ধীরস্থির, শান্ত। খুব রোমান্টিক ও শিল্পবোধসম্পন্ন তরুণ। কিছুটা স্বপ্নচারী। এক বিদেশিনী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে, সুন্দর বেহালা বাজায়। মিসেস গান্ধী ভাবলেন, এই স্বাপ্নিক ছেলেকে দিয়ে রাজনীতি হবে না। ও ডানা মেলে আকাশে উড়ুক। রাজিবকে পাইলট বানালেন তিনি।
ছোট ছেলে সঞ্জয়। সে ডানপিটে, একটু উগ্র স্বভাবের। রগচটা ছেলেটা সবার সাথে মেশে। একটু মতের অমিল হলেই মারপিটও করে ফেলে। শ্রীমতি গান্ধী এ ছেলেকেই তার রাজনীতির উত্তরসূরী করলেন।

কিন্তু বিধি বাম। আসমানি ফয়সালা ভিন্ন। যাকে তিনি রাজনীতির মাঠের জন্য তৈরি করলেন, সেই ছেলে একদিন ফ্লাইং ক্লাবের একটা প্লেন নিয়ে আকাশে উড়তে গিয়ে দুর্ঘটনায় হুট করে মরে গেলো। এরপর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে মিসেস গান্ধী নিজেও নিহত হলেন। তখন আকাশে ওড়া সেই পাইলট ছেলেটিকে মাটিতে নেমে এসে হাল ধরতে হলো মায়ের রাজনীতির উত্তরাধিকারী হিসেবে। আর রাজনীতিতে নামার পর প্রধানমন্ত্রী হয়েও রাজিবকে জীবন দিতে হলো অন্তর্ঘাতকের বোমা হামলায়!

তাহলে কি দাঁড়ালো? শ্রীমতী গান্ধী যে ছেলেকে জমিনে মানুষের রাজনীতির জন্য গড়লেন, সে বিমান দুর্ঘটনায় মরলো। আর বিমান দুর্ঘটনায় মরার আশঙ্কা ছিল যে পাইলট ছেলের, সে কিনা রাজনীতি করতে নেমে প্রাণ দিল ঘাতকের হাতে। কাজেই মানুষের পরিকল্পনা সব সময় কাজ দেয় না। সব কিছুর ওপরে যে আসমানি ফয়সালা সেই কুদরতের ওপর আমাদেরকে আস্থা রাখতেই হবে।

অনেক দিন আগের গল্প। স্বাভাবিক মৃত্যুর দ্বার পেরিয়ে তাহের ঠাকুরও অনেক আগেই গত হয়েছেন। তবুও ঘটনার নানা রকমের অভিঘাত দেখলে এখনো তার সে বয়ান মাঝে মাঝে মনে পড়ে। ভাবতে থাকি, মানুষের পরিকল্পনার বিপরীতে অকল্পনীয় আসমানি ফয়সালা যে কোনো মুহূর্তে আমাদেরকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে। সেই গভীর আস্থাটা মনের মধ্যে ক্রমাগত বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!