আমানত কমে যাচ্ছে ব্যাংকে

  • আপডেট সময় রবিবার, এপ্রিল ১৭, ২০২২
  • 360 পাঠক

দিশারী ডেস্ক

———–

প্রয়োজনে চাহিদা মেটাতেই সঞ্চয় করেন মানুষ। সঞ্চয়ের সেই অর্থ ব্যাংকে ঢুকলে তা আমানত। এটিকে ব্যাংকের জীবন সঞ্জীবনী বা রক্ত হিসেবে ধরা হয়। এর প্রবাহ ঠিক থাকলে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা ও অর্থনীতি স্বস্তির জায়গায় রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। সেই রক্তপ্রবাহে টান ধরেছে দেশের ব্যাংক খাতে।

চলতি অর্থবছরের সাত মাস ধরেই ব্যাংকে আমানত কমে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতি করোনার তীব্র প্রকোপের সময়েও ছিল না। শুধু এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে আমানত কমেছে সাত হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে এমন তথ্য। এর প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রেও। সাম্প্রতিক সময়ে কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ।

দেশের আমানত ও ঋণ পরিস্থিতি শীর্ষক বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই পরিসংখ্যান বলছে, গত ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৪ লাখ ৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এক মাস পরই গত জানুয়ারিতে তা হয়েছে ১৪ লাখ এক হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। এক মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে সাত হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনার তীব্র প্রকোপ ছিল ২০২০ সাল পুরোটা জুড়েই। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল ৯২ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমানত বেড়েছে ৫১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) গত সাত মাসে ব্যাংক খাতে আমানত আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম এসেছে ৪১ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে আমানত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক।

ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার প্রভাব কমে যাচ্ছে; কিন্তু মানুষের মধ্যে এখনও হাতে নগদ অর্থ রাখার প্রবণতা রয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রয়োজনেই এটি করছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ায় এমনটি হয়েছে।’

ব্যাংকিং হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পেলে আমানতও বাড়ে। কারণ হচ্ছে, বিতরণকৃত ঋণ আমানত হিসেবেই গ্রাহকের হিসাবে যুক্ত হয়। সেখান থেকে ব্যয় করেন গ্রহীতা। সেই অর্থ খরচ হয়ে দিন শেষে আবার ব্যাংকিং চ্যানেলেই যুক্ত হয়।

করোনার নেতিবাচক প্রভাবে ২০২০ সালের পুরোটা সময় এবং ২০২১ সালের মধ্যবর্তী পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলা যায় অচলই ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে স্থবিরতা ছিল। এসময় মানুষ সঞ্চয় ভেঙে জীবন-যাপন করেছে। তারপরও এই সময়টিতে গ্রাহকদের টাকা ছিল ব্যাংকমুখী। সম্প্রতি করোনার প্রভাব কমায় মানুষের চলাচল বেড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বিনিয়োগ বাড়ছে।

গত জানুয়ারি মাসেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের স্থিতি ছিল ১২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকে আমানত কমে যাওয়ার একটি কারণ সুদহার কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন বেসরকারি খাতের এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘সুদহার এখন অনেক কম, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতির ওপরেই সুদহার নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রতি তিন মাস অন্তর অন্তর, এটি সমন্বয় করা হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি তো প্রতিদিন ফেস করতে হচ্ছে আমানতকারীদের। তাই উচ্চ সুদ পেতে অনানুষ্ঠানিক খাতে হয়তো অর্থ জমা রাখছেন। এতে ব্যাংক খাতে সমস্যা পড়বে। এরই মধ্যে অনেকেই সুদহার বাড়াতে শুরু করেছে।’

চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক তিন শতাংশ নির্ধারণ করেছে সরকার জাতীয় বাজেটে। কিন্তু গত ফ্রেব্রুয়ারিতে তা দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক এক শতাংশে। গত ২৮ মার্চ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকার বিশেষ গুরুত্বসহ বিবেচনা করছে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে। অর্থবছরের প্রথমার্ধে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে ছয় দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত জুলাই মাসে ছিল পাঁচ দশমিক ৩৬ শতাংশ, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল পাঁচ দশমিক ৫৫ শতাংশ।’ অপরদিকে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে বলে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেম।

আমানত কমে যাওয়ার অর্থ হলো ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়া। এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কী পরিস্থিতি হয়, কয়েক দফায় দেশের ব্যাংক খাত তা অনুভব করেছে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয় কি না, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্ক হওয়া উচিত এখনই।’

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে আমানতকারীরা। মূল্যস্ফীতি বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকে আমানত কমে যাবে। কারণ হচ্ছে রমজানে সবার খরচ বাড়ে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে এবার খরচ বেশি বাড়ছে। সেই তুলনায় আয় বাড়েনি। ফলে বাধ্য হয়ে সঞ্চয়ে হাত না দেয়া ছাড়া উপায় নেই।

সঞ্চয় কমে যাওয়ার আরেকটি চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে। তথ্য বলছে, এক বছরে ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে কাগুজে নোট বা অর্থ বেরিয়ে গেছে ২৬ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। শুধু গত জানুয়ারিতেই আগের মাসের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি অর্থ বেরিয়ে গেছে। অর্থাৎ এ পরিমাণ অর্থ মানুষের হাতে রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ পরিমাণ অর্থ আসলেই জনগণের কাছে রয়েছে, না একটি শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, তা দেখা উচিত। নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া মানেই অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আমানত কমে যাওয়ায় সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রিও কমে গেছে। সরকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ১৪ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল ২৯ হাজার ৩১১ কোটি টাকা।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!