বেগমপাড়ার পর লন্ডন আর দুবাইয়ের অভিজাতেও বাংলাদেশীরা

  • আপডেট সময় রবিবার, জানুয়ারি ২২, ২০২৩
  • 161 পাঠক

সংবাদ ভাষ্য
————-
সময়, জীবন কখনো কখনো বিভ্রম তৈরি করে। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা ঠাওর করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন তৈরি হয় নিজের অস্তিত্ব নিয়েও।ঠিক আছি তো! এমনিতে বাংলাদেশি সমাজ বিভক্ত। কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নানাভাবে মানুষ নিজেকে আলাদা করেছে। যদিও তার বেশির ভাগই মেকি, বানানো।

কিন্তু মানিব্যাগ সামলাতে মানুষ যে হিমশিম খাচ্ছে তা বানানো নয়। নিজের, চারপাশের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কতো কষ্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন চলছে। এমনিতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের কঠোর সমালোচনা করে থাকেন অনেকে। তবে মানুষের জীবন যে চলছে না সেটা পত্রিকা খুললেও মাঝে মধ্যে টের পাওয়া যায়। ন্যায্যমূল্যের ট্রাকে দীর্ঘ লাইন।

সামান্য কিছু পণ্যের জন্য দিনভর অপেক্ষা। মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে। বাজারের ফর্দ ছোট করেছেন বহু মানুষ। এই যখন অবস্থা তখন সম্প্রতি অন্তত দু’টি খবর আমাদের আশাবাদী না করে পারে না! বড় এ দু’টি সুখবরের পাশাপাশি আরও কিছু সুসংবাদও আছে। যেমন, আমেরিকায় এক বাংলাদেশি এমপি’র একাধিক বাড়ি কেনার খবর এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।

তবে বড় দু’টি সুসংবাদে একবার ঘুরে আসা যায়। বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম- ‘লন্ডনের অভিজাত এলাকায় প্রপার্টির শীর্ষ বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশিরাও।’ এতে বলা হয়, ‘লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাগুলো স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডন’ হিসেবে। গোটা লন্ডনে এসব এলাকায় প্রপার্টির দাম সবচেয়ে বেশি। বহুমূল্য এসব প্রপার্টির মালিকানাকে দেখা হয় অতি ধনী বৃটিশদের আভিজাত্যের নমুনা হিসেবে।

প্রপার্টি মূল্যের ভিত্তিতে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের পরিধি ও সংজ্ঞায় বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনভুক্ত এলাকাগুলো হলো- নাইটসব্রিজ, মেফেয়ার, সাউথ কেনসিংটন, ওয়েস্ট ব্রম্পটন ইত্যাদি। শুধু বৃটিশ নয়, বিশ্বের অন্যান্য স্থানের অতি ধনীরাও এখন প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রপার্টি ক্রেতাদের অভিজাত তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন।

প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের প্রপার্টি বাজারে বিদেশিদের অবদান এখন ৪০ শতাংশেরও বেশি। ধনাঢ্য এসব ক্রেতার জাতীয়তাভিত্তিক শীর্ষ তালিকায় আছেন বাংলাদেশিরাও। প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের প্রপার্টি কেনায় জাপানি ধনীদের চেয়েও বেশি ব্যয় করেছেন তারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবা দিচ্ছে লন্ডনভিত্তিক অ্যাস্টনস।

সংস্থাটি সম্প্রতি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিভিন্ন এলাকার বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের জাতীয়তাভিত্তিক একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। বৃটিশ রিয়েল এস্টেট ও প্রপার্টি ব্যবস্থাপনা সংস্থা নাইট ফ্রাঙ্ক ও যুক্তরাজ্য সরকারের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা এ তালিকায় দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম নয় মাসে প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের তালিকায় বাংলাদেশিদের অবস্থান ছিল নবম।’

ওদিকে, প্রথম আলো’র এক রিপোর্টের শিরোনাম ছিল- ‘দুবাইয়ে দেড় বছরে ৩৪৬ কোটি টাকার ফ্ল্যাট-বাড়ি কিনেছেন বাংলাদেশিরা।’ এতে বলা হয়েছে, ‘কানাডার বেগমপাড়ার পর এবার সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বাড়ি কেনায় বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশিরা।

দুবাইয়ের সরকারি নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ১২ কোটি ২৩ লাখ দিরহাম বা ৩৪৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনেছেন।

বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত যেসব দেশের মানুষ জমি-বাড়ি কিনছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা সবার আগে। দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রেও এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

যদিও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, দুবাইয়ের আবাসন বাজারে বছরে ১৬ দশমিক ২ বিলিয়ন দিরহাম বা ৪৫ হাজার ৯১৫ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়। সেই তুলনায় বাংলাদেশিদের ৩৪৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ বড় কিছু নয় আর এই অর্থ দিয়ে দুবাইয়ে বড়জোর ১০০টি ফ্ল্যাট কেনা যাবে, এর বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশিরা সেখানে সবচেয়ে বেশি ফ্ল্যাট-বাড়ি কিনেছেন, এই দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

তবে এই অর্থ বৈধপথে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, তা অবৈধপথেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুবাইয়ে বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনার এই তালিকায় আছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও আমলারা। দুবাইয়ের এসব বিনিয়োগের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়।

এ ছাড়া দেশটিতে এক কোটি দিরহাম বা ২৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলে গোল্ডেন ভিসা দেয়া হয়।’

মাঝে ফেসবুকে একটা মজার লেখা পড়ছিলাম। উন্নত সব দেশে বাংলাদেশিদের বিপুল সংখ্যক বাড়ি থাকার খবর উল্লেখ করে বলা হচ্ছিল, এটাই ওইসব দেশ দখলের সবচেয়ে সহজ উপায়। একে একে আমরা সব বাড়ি কিনে ফেলবো। আর দখলে এসে যাবে একেকটি শহর। এমনিতে আসলে সহজে আমরা কোনো কিছুর প্রশংসা করি না। বিদেশে বাংলাদেশিদের এসব অনবদ্য সাফল্যও যেন আমরা উপভোগ করতে পারছি না!

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে, ‘‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল্য লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;’’

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতি কম নয়। উন্নয়ন-অগ্রগতিতে বহুক্ষেত্রেই চমক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে বহুগুণ। যদিও নানা পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এদেশে বৈষম্যও বেড়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি একবার বলেছিলেন, দেশের সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের দেশগুলোর মতো। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে তিন কোটি মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে- এ কথা উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি কখনোই বলিনি যে ১৭ কোটি মানুষের পয়সা বেশি হয়েছে। বাস্তবতা হলো দেশের ২০ ভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের। সেটা মাথায় রাখতে হবে।’

এক শ্রেণির মানুষের বিদেশে টাকা পাচার এবং সম্পদের পাহাড় গড়া নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে কম আলোচনা হয়নি। বিশেষকরে বেগমপাড়াতো রীতিমতো টপচার্টে রয়েছে বহুদিন ধরেই। তবে টরেন্টোতে বা কানাডায় সেই অর্থে কি কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকা আছে, যেটিকে বেগমপাড়া বলা হয়?

সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর এ ব্যাপারে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, এই বেগমপাড়া আসলে কানাডায় পাড়ি জমানো দুর্নীতিগ্রস্তদের স্ত্রীদের দ্বিতীয় নিবাস অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকা নেই, যেটিকে ‘বেগমপাড়া’ বলা হয়। তবে প্রায় বছর তিনেক আগে বিবিসি বাংলার ওই রিপোর্টে সাজ্জাদ আলি নামে টরেন্টোর একজন রিয়েল এস্টেট এজেন্টের বক্তব্য প্রকাশ করে।

তার ভাষ্য ছিল, ‘‘বেগমপাড়া যে শুধু কথার কথা, লোকমুখে শোনা ব্যাপার, তা নয়। আমরা দেখি এখানে বাংলাদেশিরা অনেক সংখ্যায়, এমন সব জায়গায় বাড়িঘর কিনেছেন, যেটা একটু অভিজাত এলাকা। কিন্তু তাদের জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে তাদের এই সম্পদ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তারা এখানে তেমন কিছু করেন বলে তো আমরা দেখি না। কীভাবে তারা এক বা দুই মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন!’’

একদিকে মানুষের পেট চালাতে নিদারুণ লড়াই। অন্যদিকে, বেগমপাড়ায় বিত্তবৈভবের বেড়ে চলা। এই বিভ্রমের মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। বেগমপাড়া তো একটি প্রতীক মাত্র। এরইমধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, বেশ কয়েকটি দেশেই এমন বেগমপাড়া গড়ে তুলেছেন আমাদের প্রিয় কিছু বাংলাদেশি। তাদের অর্থের কতোটা এ দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে তার তদন্ত অপরিহার্য। দেশের অর্থ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন দেশে। ন্যায়বিচারের আশা কখনোই ত্যাগ করা উচিত নয়।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!