কোটিপতিদের দখলে ঋণের সিংহভাগ , তেলের মাথায় তেল

  • আপডেট সময় শুক্রবার, জানুয়ারি ২৭, ২০২৩
  • 288 পাঠক

ডেস্ক, দৈনিক দিশারী

——————-

ব্যাংকঋণের ৭৩ শতাংশই ভোগ করছেন কোটিপতিরা। বাকি ২৭ শতাংশ জুটেছে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকদের ভাগ্যে। যাদের ঋণসীমা ১ কোটি টাকার নিচে। হিসাব বলছে, কোটি টাকা ঋণের গ্রাহকসংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার জন হলেও তুলনামূলক স্বল্প ঋণের গ্রাহকসংখ্যা ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৭ হাজারেরও বেশি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহৎ ঋণের চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহকরা। কিন্তু দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ছোট উদ্যোক্তারাই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের আমানতকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ৮৮ জন। তাদের জমাকৃত টাকার পরিমাণ ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা।

একই সময়ে ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক। যেখানে ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮২ জন। অর্থাৎ ১৩ জনের জমাকৃত টাকা ভোগ করছেন মাত্র একজন। এটা ছিল সার্বিক হিসাব।

কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ব্যাংকঋণের বেশিরভাগই ভোগ করছেন কোটিপতি গ্রাহক। বঞ্চিত হচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের হাজারো উদ্যোক্তা।

একজন জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার জানান, প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক, মুটে, মজুর, দোকানদারের খুব বেশি ঋণের প্রয়োজন হয় না। তারা কখনও ৫০ হাজার, ১ লাখ বা ব্যবসাভেদে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ করেন।

কিন্তু তাদের পেছনে সময় দিতে চান না ব্যাংকাররা। তাই ছোটদের ঋণ পাওয়ার জন্য গলদঘর্ম হওয়ার উদাহরণ ভূরি ভূরি। নানান ধরনের শর্তের কারণে ব্যাংকবিমুখ হাজারো ক্ষুদ্র গ্রাহক।

কিন্তু সম্পর্কের খাতিরে অথবা কমিশনের মাধ্যমে কোটিপতিরা খুব সহজেই ঋণ পেয়ে যান ব্যাংক থেকে। এর ফলে প্রান্তিক পর্যায়ের হাজারো মানুষ এবং ছোট চাকুরেদের জমানো টাকার সিংহভাগ সুবিধা ভোগ করেন ওপরতলার মানুষ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৩ হাজার ৪১০ জন। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫৫৫ কোটি।

হিসাব অনুযায়ী, দেশের সব ব্যাংক মিলিয়ে যত টাকা ঋণ বিতরণ করেছে তার ২৭ দশমিক ৮০ ভাগ রয়েছে এই ৩ হাজার ৪১০ জনের হাতে। ২০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৯ হাজার ২৪১ জন, যাদের কাছে আছে ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। যা ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৪১ দশমিক ১৫ শতাংশ। ৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এমন গ্রাহকের সংখ্যা ৩৪ হাজার ১৬১ জন। তাদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে ৭ লাখ ৮৭ হাজার ২১১ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকের মোট ঋণের ৫৯ দশমিক ১০ শতাংশ রয়েছে এসব গ্রাহকের কাছে।

১ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০৮ জন। তাদের হাতে রয়েছে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অঙ্কে যার পরিমাণ ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা।

ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও এগিয়ে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। কারণ ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৬৩ দশমিক ৪০ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের গ্রাহকদের কাছে। ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগের ব্যবসায়ীরা। বাকি অংশ বিতরণ করা হয়েছে দেশব্যাপী।

তথ্যমতে, রিয়েল এস্টেট খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়েছে গত বছর। কারণ ৮ লাখ ৬৫ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে রিয়েল এস্টেট খাতে। হিসাব অনুযায়ী এই অঙ্ক ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণকৃত মোট ঋণের ৬৪ দশমিক ৯১ শতাংশ।

অন্যদিকে ফসল উৎপাদনের জন্য বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ২৬ হাজার ১৪৮ টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব খাতে ঋণ আদায় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি, সেসব খাতে ঋণ দিতে আগ্রহ কম ব্যাংকের। উল্টোদিকে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে তুলনামূলকভাবে আশঙ্কাজনক বৃহৎ শিল্প খাতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে শিল্প খাতের খেলাপি ঋণও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন শেষে শিল্পঋণে খেলাপির পরিমাণ ৫ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা বেড়ে ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকার ঘরে পৌঁছয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছর ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৮৭ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা বা ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

ওদিকে বড় ঋণ বিতরণ হলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী বিতরণের তুলনায় আদায়ের হার ৭১ শতাংশ। এ ছাড়া শিল্প খাতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৫৮ হাজার ১৪৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

এদিকে, গত অর্থবছরে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। যেখানে ঋণখেলাপির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সুতরাং শিল্প খাতের তুলনায় কৃষি খাতের খেলাপির সম্ভাবনা কম। আবার জুন পর্যন্ত কৃষি খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৪৯ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে ৩৫ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। সুতরাং আদায়ের হার ৭৮ শতাংশেরও বেশি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ বাড়লে এখানে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মোটকথা সার্বিক অর্থনীতি ও দেশ উপকৃত হয়। কিন্তু কৃষি, এসএমই ও ক্ষুদ্রঋণে পরিশ্রম বেশি হওয়ার কারণে কিছু কিছু ব্যাংক এসব খাতে ঋণ দিতে একেবারেই অখুশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত অর্থবছর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ৭ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা সবুজ অর্থায়নে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক, যা শিল্প খাতের বিনিয়োগের তুলনায় অতি নগণ্য।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শিল্প খাতে ছোট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বড়দের খেলাপির হার বেশি। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি হওয়ার পরও বারবার ঋণ পাচ্ছে। তাই এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে।

এ ছাড়া পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধার কারণে এ খাতের দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণ বেশি। এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের নতুন করে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। নতুন ঋণ যাতে না বাড়ে এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ খাতে খেলাপি ঋণ কমবে।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!