অতিরিক্ত বইয়ের বোঝাই ব্যাহত হচ্ছে শিশুর শাররিক ও মানসিক সুস্থ্যতা

  • আপডেট সময় শনিবার, মার্চ ১১, ২০২৩
  • 164 পাঠক

————————

আবুল কাশেম উজ্জ্বল

প্রকাশকাল, ১১ মার্চ, ২০২৩

———————-

একটা সময় ছিল যখন আমার মতো অসংখ্য শিশুকে বই হাতে নিয়ে লম্বা পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হতো। সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠ্যবইও ছিল কম, অনেকেই মাটির স্লেটে লিখত। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই ছিল না বললেই চলে। কলমের ব্যবহার ছিল বড় শ্রেণিতে, অন্যরা পেন্সিল ব্যবহার করত। দলবেঁধে যাওয়া-আসার পথে চলত মজার মজার দুষ্টুমি, কখনও বই মাটিতে রেখেই খেলা।

অভিভাবকদের, বিশেষত মায়েদের দায়িত্ব ছিল সময়মতো আমাদের তৈরি করে বিদ্যালয়ের জন্য বিদায় দেওয়া। এটা ছিল তখনকার গ্রামীণ সমাজের স্বাভাবিক চিত্র, হয়তো অনেক শহর এলাকায়ও একই ছিল। ঘড়ি ছিল না বলা ভালো, আমরা চলতাম আমাদের মন-ঘড়ির সময় ধরে। এভাবেই আমাদের শিক্ষাজীবনের শুরু এবং পরবর্তীতেও যে খুব সুযোগ-সুবিধা পেয়েছি, তা বলা যায় না।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেছে, বদলে গেছে শিশুদের বিদ্যালয় জীবন। সরকারি আইনে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে হলে ৬ বছর হতে হয়, যদিও নার্সারি ও প্রাক-প্রাথমিকে আরও আগেই ভর্তি হতে হয়। আামদের দেশে কয়েক লাখ শিশু দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ছে এবং প্রতি বছর সে সংখ্যা বাড়ছে। সময় বদলেছে, এখন বিদ্যালয় মানেই পিঠে ব্যাগভর্তি বই-খাতা-কলম।

শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পিঠে ব্যাগ থাকার বিকল্প নেই। শ্রেণি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যাগের আকার ও ওজন বদলে যায়; তবে মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নতা রয়েছে। ফলে শিশুদের প্রতিদিন বিশাল একটি ব্যাগ পিঠে নিয়ে যেতে-আসতে হয়। তাদের এ ব্যাগের আকার ও ওজন প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন হতে দেখা যায়।

সাধারণত একটি শিশুর ব্যাগে থাকে যত পাঠ্যবই ও তত সংখ্যক খাতা, কলম-পেন্সিল ও খাবারের বাক্স ও পানির বোতল। অর্থাৎ কোনো শ্রেণিতে যদি পাঁচটি পাঠ্যবই থাকে, তাহলে এর সঙ্গে আরও পাঁচটি খাতা থাকতে হয়। তাহলে এসব কিছুর ওজন শিশুরা প্রতিদিন পিঠে করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। এখন দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিদ্যালয়ে নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে আরও কিছু বই থাকে।

অনেক বেসরকারি বিদ্যালয়ে ২য় বা ৩য় শ্রেণি থেকেই বাংলা ও ইংরেজি ২য় পত্র, সাধারণ জ্ঞানসহ বাধ্যতামূলক বিষয় চালু রয়েছে। ফলে তাদের ব্যাগের আকার ও ওজন বাড়ছে। এ বাড়তি ওজনও শিশুদের বহন করে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। শিশুদের এ ব্যাগের ওজন প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরতদের জন্য এটা নিয়মিত। একাধিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অতিরিক্ত ওজন বহনের কারণে শিশুদের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।

চিকিৎসকদের মতে, ভারী স্কুলব্যাগের জন্য শিশুর শরীরে নানা বিরূপ প্রভাব পড়ে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কাঁধের মাংশপেশি শক্ত বা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া; ফলে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলে ব্যথার সৃষ্টি হয়। শরীরের একদিকে ভারী ব্যাগ বহনের ফলে দুই কাঁধের ভারসাম্য হারায়। এমনকি মেরুদণ্ড ডানে, বাঁয়ে বা সামনের দিকে কিছুটা বেঁকে যেতে পারে। ফলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তাদের এ শাররিক সমস্যা পরবর্তী জীবনেও প্রভাব ফেলতে পারে এবং অনেকের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছেও। বলা হয়, সুস্থ দেহ সুন্দর মন কিন্তু আমরা তাদের দেহটাকেই ভারাক্রান্ত করছি যে তাদের সুন্দর-কোমল মনটাকে জীবনের শুরুতেই কঠিন করে দিচ্ছি। জীবনের শুরুতেই তাদের আমরা ভার চাপিয়ে দিয়ে কী বার্তা দিচ্ছি?

বিশেষজ্ঞদের মতে, স্কুলব্যাগের ওজন হওয়া উচিত শিশুর শরীরের ওজনের সর্বাধিক ১০-১৫ শতাংশ। সে হিসেবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের স্কুলব্যাগের ওজন দেড় থেকে দুই কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিশুদের স্কুলব্যাগের ওজন সর্বাধিক তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি হতে পারে। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের স্কুলব্যাগের ওজন সর্বাধিক পাঁচ থেকে ছয় কেজি হতে পারে। শিশুদের স্কুলব্যাগের ওজন নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে সরকারি সিদ্ধান্ত আছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে।

আমাদের দেশেও হাইকোর্টের ২০১৬ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী, একটি শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি তার স্কুলব্যাগের ওজন হবে না। হাইকোর্টের বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও আশিস রঞ্জন স্কুলব্যাগ নিয়ে এই রায় দেন ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। তাঁরা ছয় মাসের মধ্যে এ নিয়ে আইন ও বিধি প্রণয়নের নির্দেশ দেন আইন সচিব, শিক্ষা সচিব, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও মানবাধিকার কমিশনকে। আর স্কুলগুলোকে ব্যাগের ওজন তদারকি করতে বলা হয়। কিন্তু তারপরও স্কুলব্যাগের ওজন থেকে এখনও রেহাই পচ্ছে না শিশুরা ৷

কিছু বিদ্যালয়ের শিশুদের অবস্থা তো আরও নাজুক, বিশেষ করে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর শিশুদের। ওইসব বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিশুদের স্কুলব্যাগের ওজন ৬-১০ কেজিও হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও তাদের নির্বাচিত পুস্তক প্রণেতারা প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের কারিকুলাম প্রণয়নের কাজ করেন। অর্থাৎ তাঁরা সবকিছু বিবেচনা করেই পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি তৈরি করেন। কিন্তু যখন বেসরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে আরও কিছু বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে সংযুক্ত করে, তখন আমরা ভিন্ন বার্তা পাই। এর সরল অর্থ হচ্ছে, সরকার নির্ধারিত কারিকুলামকে তাঁরা যথেষ্ট মনে করেন না। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সরকারি ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত লাখো শিশুর মেধা বিকাশের কী হবে? আর যদি সরকার মনে করে তাদের প্রণীত কারিকুলাম যথেষ্ট, তাহলে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো কীসের ভিত্তিতে নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করছে? যদি বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর জন্য কোনো নির্দেশনা থেকে থাকে, তাহলে তা কি তদারক হচ্ছে?

আমি মনে করি, এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বশীলদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা দরকার। একই দেশের, একই শহরের শিশুরা ভিন্নভাবে শিক্ষা গ্রহণ করবে তা মেনে নেওয়া কষ্টকর। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সরকারি নির্দেশনা আছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবে যদি থাকেও, সে ক্ষেত্রে এর একটা সর্বোচ্চ সীমা থাকা দরকার।

প্রতিদিন সকালে দেখা যায় রাস্তায় অসংখ্য শিশু ছুটছে বিদ্যালয়ে, ব্যাগের ভারে তাদের শরীর চলতে চায় না। ফলে অনেক অভিভাবক বাধ্য হয়েই সে ব্যাগ নিজেই বহন করেন। সব শিশুর সে ভাগ্যও হয় না। আর যাদের যাদের একাধিক সন্তান বিদ্যালয়গামী, তাদের জন্য সেটা আরও কষ্টকর। ফলে বাধ্য হয়েই শিশুর পিঠেই ব্যাগ দিতে হয়। যেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাগ ভারী হওয়ার কথা, সেখানে আমাদের দেশে বিপরীত চিত্র।

শিশুকাল থেকেই বইয়ের বোঝা চাপিয়ে তাদের মেরুদণ্ড বাঁকা করার কাজটা বন্ধ করা হোক। বরং তাদের শাররিক ও মানসিকভাবে বিকশিত করাই হোক আমাদের শিক্ষার মূলনীতি। কেবল উপযুক্ত নীতি প্রণয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, দরকার এর সঠিক বাস্তবায়ন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা আদালত অবমাননা করার শামিল– এ সত্যটা উপলব্ধি করতে হবে।

শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করুন

এ বিভাগের আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!